সাহিত্যিকা

রবীন্দ্রনাথের ‘রথের রশি’ – আজকের প্রাসঙ্গিকতা – প্রমীত বসু

প্রমীত বসু, ২০০১ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং

রথের দড়িটা আটকে গেছে।

যাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা, তাদের মধ্যে থেকে অনেকে অনেক চেষ্টাচরিত্র করল, কিন্তু দড়ি পড়ে রইল একই ভাবে, তাই রথও আর এগোল না।

এখন দড়িটাকে কী করে টেনে তোলা যায় সে চিন্তা না করে একদল ছুটে এল গালমন্দ পাড়তে। তলিয়ে দেখার চেষ্টা বা ধৈর্য এদের মধ্যে প্রায় কারুরই নেই, তাই শুধু অপবাদ দিয়েই নিজেকে দায়মুক্ত করা।

 

কেউ বলে, ‘ঐ দড়িটা দেখে ভয় লাগছে, মনে হচ্ছে ও যেন ক্রমে ক্রমে সাপ হয়ে ফণা ধরে উঠবে। মনে হচ্ছে ওটা এখনি ধরবে ফণা, মারবে ছোবল।’

কেউ বলে, ‘বীভৎস হয়ে উঠেছে, যেন বাসুকি ম’রে উঠল ফুলে।’

কেউ বা বলে, ‘আমার কেমন মনে হচ্ছে ঐ রশিটা যেন যুগ-যুগান্তরের নাড়ীর মতো দব্‌দব্‌ করছে।’

আবার কেউ বলে ওঠে, ‘দড়িটা পড়ে আছে পথের মাঝখানে, যেন একজটা ডাকিনীর জটা।’

**************

 

কেউ কেউ আশায় থাকে যে ‘রথ চলবে কোনো এক পুণ্যাত্মা মহাপুরুষের স্পর্শ পেলে।’

 

দু এক জনে বোঝে সমস্যা অনেক গভীরের… কোনো একক পুণ্যাত্মার কাজ নয় এটা, দায়িত্ব নিতে হবে সকলকে। তাই তারা বলে, ‘আমাদের সঙ্গে পুণ্যাত্মাদের তফাতটা এই যে, গুন্‌তিতে তারা একটা-দুটো, আমরা অনেক। যদি ভরসা করে সেই অনেকে মিলে টান দিতে পারি রথ চলবেই। মিলতে পারলেম না বলে টানতে পারলেম না, পুণ্যাত্মাদের জন্যে শূন্যের দিকে তাকিয়ে রইলেম।’

কিন্তু সংখ্যার অনুপাতে তারা গুটিকয়েক, লক্ষ কোটির অশ্লীল কোলাহলের ভিড়ে তাদের কথা কারুর কানে পৌঁছয় না, পৌঁছলেও গ্রাহ্য হয় না কোনোভাবে।

 

কারুর থাকে ভক্তি, অসীম ভক্তি। ঈশ্বরে, জড়ে, অলীক কল্পনায় এক অচল ভক্তি। সেই ভক্তির বৈঠা বেয়ে ভরসা করে কোনোভাবে জীবনের বৈতরণী পেরিয়ে গেলেই চলবে। সব সমস্যার সমাধান হবে ভক্তিরসে ভর করে কোনো এক অলৌকিক উপায়ে। তাই সেই ভক্তির ওপর দাঁড়িয়ে তারা পূজো করে ওই অচল রশিটাকেই। বলে ওঠে, ‘গড় করি তোমায় দড়ি-নারায়ণ! প্রসন্ন হও। এনেছি তোমার ভোগ। ওলো, ঢাল্‌ ঢাল্‌ ঘি, ঢাল্‌ দুধ, গঙ্গাজলের ঘটি কোথায়, ঢেলে দে-না জল। পঞ্চগব্য রাখ্‌ ওইখানে, জ্বালা পঞ্চপ্রদীপ। বাবা দড়ি-নারায়ণ, এই আমার মানত রইল, তুমি যখন মাথা মুড়িয়ে চুল দেব ফেলে।’

************

 

সমাজের উচ্চকোটির মানুষ যারা, তারা ভাবে রথকে এগিয়ে নিয়ে চলার দায়িত্ব কোনোদিনই তাদের ছিল না, আর তাই আজ সেটা তাদের নয়। তারা সমাজের ভোক্তা, তাদের গতিবিধি সীমিত শুধুমাত্র ক্ষমতার অলিন্দে, সুবিধের নির্যাসটুকুর বরাদ্দ শুধুমাত্র তাদেরই জন্য।

তাই তারা বলে, ‘আমরা ক্ষত্রিয়, আমরা তো শূদ্রের মতো গোরু নই— রথ টানা আমাদের কাজ নয়, আমাদের কাজ রথে চড়া।’

 

অথচ অন্ত্যজ শ্রেণীর সামান্যতম অধিকারের দাবিও তাদের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে।

তাদের মুখে শোনা যায়, ‘এখনকার শুদ্ররা চোখ রাঙিয়ে বলে কিনা আমরা কি মানুষ নই। কালে কালে কতই শুনব! কোন্‌দিন বলবে, ঢুকব দেবালয়ে। বলবে, ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়ের সঙ্গে নাইব এক ঘাটে।’

 

ক্ষমতার দম্ভে কারুর কারুর মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে চূড়ান্ত গর্জন— ‘চল্‌-না ওদের পাড়ায় গিয়ে প্রমাণ করে আসি— ওরাই মানুষ না আমরা।’

 

অথচ সেই তাদেরই দম্ভের জায়গায় আসে শঙ্কা, যখন ধনপতিরা সেই রথের রশি হাতে নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। তাদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ বলে বসে, ‘বেনের টানে যদি রথ চলে তা হলে আমরা অস্ত্র গলায় বেঁধে জলে ডুবে মরব।’

 

ধনপতিরা কাজের মানুষ, তাই সামান্য কথায় বুঝিয়ে দেয় সমাজের ভিতরকার আসল কাঠামোটা।

তারা বুঝিয়ে দেয়, ‘আজকাল যা-কিছু চলছে সবই তো ধনপতির হাতে চলছে। আজকাল আমাদের রাজত্বে রাজা থাকেন সামনে, কিন্তু পিছনে থাকে বেনে। পিছনে যে থাকে ঠেলাটা যে তারই।’

 

তাই রশি আর এগোয় না, যেখানে পড়ে থাকার সেখানেই থাকে স্থাণুবৎ দলাপাকানো এক পিণ্ডের মত।

***********

 

এদের সবার থেকে আলাদা হয়ে থাকে কিছু কবি। হয়তো আদতে তারা চারণকবি, যারা সবার মধ্যে থেকেও আলাদা করে বলে উঠতে পারে মানুষের কথা, সাম্যের কথা। আলাদা করে দেখিয়ে দেয় রশির জড়তার কারণ।

 

সেই ক্ষমতার বেড়াজালে থাকা মানুষগুলোর দিকে চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে:

‘ওদের মাথা ছিল অত্যন্ত উঁচু,

মহাকালের রথের চূড়ার দিকেই ছিল ওদের দৃষ্টি—

নীচের দিকে নামল না চোখ,

রথের দড়িটাকেই করলে তুচ্ছ।

মানুষের সঙ্গে মানুষকে বাঁধে যে বাঁধন তাকে ওরা মানেনি।

রাগী বাঁধন আজ উন্মত্ত হয়ে ল্যাজ আছড়াচ্ছে।’

 

আর বাকি সবার দিকে তাকিয়ে বলে:

‘তার পরে কোন্‌-এক যুগে কোন্‌-একদিন

আসবে উলটোরথের পালা।

তখন আবার নতুন যুগের উঁচুতে নিচুতে হবে বোঝাপড়া।

এই বেলা থেকে বাঁধনটাতে দাও মন—

রথের দড়িটাকে নাও বুকে তুলে, ধুলোয় ফেলো না;

রাস্তাটাকে ভক্তিরসে দিয়ো না কাদা করে।

আজকের মতো বলো সবাই মিলে—

যারা এতদিন মরে ছিল তারা উঠুক বেঁচে;

যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে, তারা দাঁড়াক একবার মাথা তুলে।’

 

এই কবিদেরকেই আমরা দেখতে পাই ভিন্ন স্থানে, ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন নামে। কখনো তারা আসে ফাদার স্টান স্বামীর বেশে, কখনো বা ভারাভারা রাও আবার কখনো বা বিনায়ক সেন-রূপে। সমাজের রাজন্যবর্গ বা ধনপতিদের কাছে তারা অস্বস্তির কারণ হয়ে রয়ে যায়। তাই কবিদের জীবন কখনোই মসৃণ থাকে না, কিন্তু তারা থেকে যায় মানুষের কাছে, ইতিহাসের কাছে রথের রশির চালক হয়ে।

Sahityika Admin

Add comment