সাহিত্যিকা

মায়ের গালগল্প – অঙ্কিতা মজুমদার

অঙ্কিতা মজুমদার, ২০০৯ ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

আমার মা অঙ্কের দিদিমণি। মায়েদের আমলে যখন মেয়েরা বিশেষ বিজ্ঞান পড়ে না, আমার মা ছিল বিজ্ঞান শাখার স্নাতক। এইখানে ভারী মজার একটা গল্প আছে। আমার মা ক্লাস ইলেভেনের পরীক্ষার পর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্সে চান্স পায়। মা যখন পড়াশোনা করেছে তখন উচ্চমাধ্যমিক ছিল না, নাইন টেন ইলেভেন একসাথে পড়তে হত সায়েন্স কিম্বা আর্টস নিয়ে। তারপর বোর্ড এক্সাম হত। সেই বোর্ড এক্সামের বেড়া টপকে কলেজ। রসায়ন মার বরাবরের প্রিয় বিষয়। কৃষ্ণনাথ কলেজ বহরমপুরের বিখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠান। অথচ তখন সেখানে মেয়েরা বিশেষ পড়ে না। ওই যে বললাম তখন মেয়েরা বিজ্ঞান শাখায় সাধারণতঃ পড়ত না। যারা পড়ত তারা সাধারণত অনার্স পড়ত না তারওপর রসায়নের মত একটি জটিল বিষয় খুব কম মেয়েই সেই শহরে তখনকার দিনে পাঠ্য হিসেবে বেছে নিত। ছেলে মেয়েতে একসাথে পড়ার চল তখনো সাধারণ একটি বিষয় হয়ে ওঠেনি। এহেন সময়ে আমার মা ছিল একটিমাত্র মেয়ে যে রসায়নে অনার্স নিয়ে পড়ার সুযোগ পায়। গোটা ক্লাসরুমে একটিমাত্র মেয়ে বিষয়টিই তখন ভাবনার অতীত। তার ওপর কেমিস্ট্রি মানেই ল্যাব করতে হবে। ল্যাব করা মানেই পার্টনার লাগবে। পার্টনার কিভাবে একজন ছেলে হতে পারে ভেবে মায়ের ঘুম উড়ে গেল। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে পার্টনার, এই ভাবনাটার ভেতরেই কেমন একটা আঁশটে গন্ধ আছে বোধহয়। তা সে যতই ল্যাবে হোক। পার্টনার মানেই বুঝি নিষিদ্ধ নগরীর ডাক। আমার মা আবার অতিশয় লক্ষ্মী একটি কিশোরী। নম্র, ভদ্র, সমাজের সকল নিয়মাবলী মেনে চলা। এই মহিলা আজীবন সবরকম বিতর্ক থেকে দুরে থাকেন এবং মেয়েদেরও রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। সে বিষয়ে কতটুকু সফল হন সে আবশ্য অন্য কথা। রসায়ন যতই প্রিয় হোক তার জন্য একটি ছেলে পার্টনারের পাশে দিনভর দাঁড়িয়ে থেকে ল্যাব তো করা যাবে না। অতএব রসায়নকে বিদায় জানানো ছাড়া উপায় কি ! মায়ের বড়দাদা নাকি বহুবার কাকুতি মিনতি করেছিলেন অনার্স পড়ার জন্য। জেদি মেয়ের এক গোঁ। “তাহলে একটা মেয়ে ছাত্রীর ব্যবস্থা করে দাও বড়দা।” বড়দা তো আর রাতারাতি একজন রসায়নের ছাত্রী তৈরি করে ফেলতে পারেনা। অগত্যা বোনের জেদের কাছে হেরে গিয়ে তাকে বহরমপুর গার্লস কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পাসকোর্সে ভরতি করিয়ে দিয়ে এলেন। ছোটবেলা থেকে মায়ের মুখে এই গল্প আমি অসংখ্যবার শুনেছি।যতবার শুনতাম, বুকের ভেতর একটা শুকনো মুখের কিশোরীর ছবি ভেসে উঠত যে তার প্রিয় বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগ হেলায় ত্যাগ করেছিল কেবলমাত্র লোকেরা কি ভাববে এই ভেবে। প্রত্যেকবার গল্পটা শুনতাম আর বালিকা আমি মাকে প্রশ্ন করতাম যদি আমারও একইরকম হয় কলেজে গিয়ে তখন ! আমার ক্লাসেও যদি আর কোন মেয়ে না থাকে ? তখন কি আমি পড়া ছেড়ে দেব ?

“তোরা তা করবি কেন পাগলি? তুই পড়বি।“ মা হাসিমুখে জবাব দিতেন।

“তাহলে তুমি পড়লে না কেন মা?”

“তখন সময় অন্য ছিল রে বাবুন।”

আসলে সময় এখনো অন্যই আছে। কেবল খোল নলচের বদল হচ্ছে। তাও যে হচ্ছে সেই বা কম কি ! আমার কিশোরী মায়ের কথা ভেবে তখনও বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা করত, এখনো করে।সেই ব্যথা কম করতেই নাকি কিজানি ইতিহাস সত্যিই ফিরে এসেছিল। বি ই কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথমদিন ক্লাস করতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল একটা বয়েজ ঈশকুলে এসে পড়েছি বোধহয়। সেখানে একটিমাত্র মেয়ে এবং সেটি এই শর্মা। হঠাৎ বড় হাসি পেয়ে গেল। এ তো আমার চেনা গল্প। তবে কি সত্যিই প্রকৃতি বিভিন্ন সময়ে একই ছবি তৈরি করে রাখে একটা বৃহত্তর এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য?

আমাকে দুবার ভাবতে হয়নি। আমাদের আর দুবার ভাবতে হয় না। পরের চারটে বছর ওই ছেলেগুলোই ল্যাব থেকে ক্লাস, ক্যান্টিন থেকে রাস্তাঘাট, হৃদয়ের ভেতর থেকে বাহির সবটা জুড়ে ভরে রেখেছিল। আমি বোধহয় প্রকৃতির এক্সপেরিমেন্ট সফল করতে পেরেছিলাম।

মায়েরা থাকে বলেই দিনের শেষে আমরা কোন না কোন এক্সপেরিমেন্ট ঠিকই সফল করে ফেলি।

*************

আমার যা কিছু

আগের বছর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর থেকে মা ওপরে আমার ঘরে ছিল। আমার ঘরটা ভেতরে বলে ঐখান থেকে খাট বার করে মায়ের হসপিটাল বেড, মেশিন পত্তর, টেবিল, যাবতীয় কিছু রাখা হয়েছিল। মা যাওয়ার পরে বহুদিন ওইঘরটা ওরম ভাবেই রাখা ছিল। বাবা কেবল একটা আলনা ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি বাইরের ঘরটাতেই থাকতাম। আমার ঘর কাম মায়ের ঘরটায় ঢুকতামই না। ঠিক যেমন আমি নীচে মায়ের ঘরেও দরকার ছাড়া পারতপক্ষে ঢুকতাম না। আমার অদ্ভুত মনখারাপ হয়ে যেত। সারাবাড়ি যেমন ইচ্ছে থাক, মায়ের ঘরে মা খাটের উপর বসে নাই, এই ব্যাপারটা সামহাউ আমি নিতে পারতাম না। অতীত কাল ব্যবহার করছি মানে এই নয় যে এখন দারুণ পারি। ওই আর কী!

 

তা যা বলছিলাম, বেশ কয়েকদিন আগে মায়ের হসপিটাল বেডটা বিক্রি করে দিলাম। তারপর বাবা আমার খাট আবার আমার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আলনা বার করে দিয়েছে। মোটামুটি আমার ঘর যেমন ছিল কার্ত্তিক মিস্তিরি কাকুকে ডেকে প্রায় তেমন করে দিয়েছে। এইদিন বাড়ি গিয়ে আমি টেবিলপত্তর পরিষ্কার করে একখান ট্রান্সপ্যারেন্ট সাদা ওড়না, কাজ করা, টেবিলক্লথ করে পেতে দিয়েছি। টেবিল ক্লথ আমাদের বাড়িতে বিস্তর আছে কিন্তু খুঁজতে ল্যাদ লাগায় আর ওই ওড়নার কাপড়টা টেবিলক্লথ হিসাবে মানিয়ে যাওয়ায় আর চাপ নিইনি। বিছানা গুছিয়ে বহুদিন পর আমার ঘরে শুতে গেলাম। অথচ প্রথম রাতে ঘুমই এলনা। সারাক্ষণ কেবল মনে হচ্ছে আরে আমি এইখানে কিভাবে শুয়ে আছি! তাহলে মা কই শুয়েছে! বনানী দিই বা কই! ঘুমিয়ে গেলেই এইসব মনে হয় আর জেগে উঠি। আস্তে আস্তে ধাতস্থ হলাম যখন, তখন টের পেলাম এই ঘরটা একটা অন্য ব্যাপার। আমার ঘরে তিনটে জানালা। ঘরের চার দেওয়ালের এক দেওয়াল ভরা দুইটা জানালা আর তার উল্টোদিকের দেওয়ালে একটা। দুই জানালা ভরা দেওয়ালের কাছে খাট রাখা। জানালার বাইরে শিউলি গাছের সবুজ পাতা। তার ওপারে তিতলির ঘর। খাটের বাঁ দিকে কাঠের ছোট্ট দোতলা টেবিল রেখেছি এখন। আমার কাজের জায়গা। আমার ল্যাপটপ, খাতা, পেন। একটা দেওয়ালে কাঁচের দেওয়াল আলমারি যেমনটা আমাদের সব মধ্যবিত্ত বাড়িতে থাকে। সেই কাঁচের ভেতর ভর্তি বই। নিচের দুই তাকে অবশ্য এটা সেটা রাখা। বাবা আবার আমার হারমোনিয়ামটাও আমার ঘরে এনে আবার রেখে দিয়েছে। গান গাইনা বলে আর হারমোনিয়াম নষ্ট হয়ে গেল বুঝি বলে অসন্তোষও প্রকাশ করেছে। গোটা তিনদিন বাড়িতে ছিলাম। তার ভেতর বেশিরভাগ সময় আমার ঘরে। বাবা তো সারাদিন হয় কাজ করে, পুজো করে, নাহলে বই পড়ে। আমি থাকলে অবশ্য তার মাঝে আমার সাথে গল্প করে। বাকি সময় আমি আমার ঘরে ছিলাম এইবার। ক্লাস নাইন টেনে পড়ার সময় প্রথম আমার নিজের এই ঘরটা হয়। তার আগে এঘর ওঘর করে দিন কাটত। এই ঘর হওয়ার পরেও আমি রাতে মার কাছেই ঘুমাতাম। চাকরি করতে যাওয়ার পরে মাঝে মাঝে একা ঘুমাতাম। ঘরে ঢুকলেই কিযে একটা ব্যাপার হয়। মনে হয় এই দেওয়ালগুলো বুঝি সব জানে। ক্লাস টেনে পড়ি যখন স্কুলের এক বোন একটা ছবি দিয়েছিল বাঁধানো পাহাড়ের। সেই পাহাড়ের চূড়ায় সাদা বরফ। মা সেই ছবি আমার ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়েছিল। সেই ছবি আমার দেওয়ালে এখনো ঐভাবেই আছে। ঠিক যেভাবে আমার সেই চোদ্দ পনেরো বছর বয়স থেকে সব ছবি দেওয়ালের ইঁটগুলোতে লেগে আছে। আমি যেখানে যখনই থেকেছি, নিজের মত করে বাড়ি বানিয়ে নিয়েছি, সাজিয়েছি, যত্ন করেছি। এই একটা ঘরেই আমায় কখনো কিছু করতে হয়নি। সবটা আপনিই ছিল। আমার ঘরটা জাস্ট আমার হয়ে গেছে। লাস্ট যখন বাবা মা ঘর রঙ করালো, সারা বাড়িতে অদ্ভুত অদ্ভুত রং দিয়েছিল পাল্টে। কেবল আমার ঘরের রঙ একই ছিল। আমার ঘরে কোনরকম বদল হতে দেয়নি কেউ। যেন আমি ফিরে এলেই সব আগের মত পাই! যেন এই একটা জায়গা কেবল আমার বলে তোলা থাকে।

 

পরশু সন্ধেবেলা যখন তিতলিদের বাড়ি গেলাম, সে একটা ওয়াল হ্যাংগিং ধরিয়ে দিল। আমার বাড্ডে গিফ্ট কি! পরে মনে হল। তাই আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। এই মেয়ে ঠিক প্রত্যেকবার আমায় বাড্ডে গিফ্ট দেয়। আমি কিস্যু দিই না। সে নিজে হাতে কাপড়ের সিঙাড়া মত বানিয়ে বানিয়ে কী সুন্দর একটা ওয়াল হ্যাংগিং বানিয়ে ফেলেছে। আমি তো অবাক। অবশ্য সে প্রায়ই নানানকিছু বানাতে থাকে। প্রথমে ভেবেছিলাম ঐটা কলকাতায় নিয়ে আসব। তারপর মনে হল আমার ঘরে থাক। কাজ করার টেবিলের ঠিক পাশে টাঙিয়ে দিয়েছি। পরে বুঝলাম ঐটা ঐখানেই থাকার কথা। কিছু আদরে চিরকালের গন্ধ লেগে না থাকলে বড্ড ছাড়া ছাড়া লাগে।

 

আমার ভেতরে, আনাচে কানাচে, ছোটবেলার জমিন জুড়ে যেসব মুখগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, তাদের যাবতীয় কিছু আমার ঘরেই রাখতে হবে তো! ঠিক যেরকম প্রত্যেক রাতেই ঘুমিয়ে গেলে টের পাই সুখ আমার জন্য আগলে রাখাই আছে। কেবল ফিরতে যেটুকু দেরী!

 

Sahityika Admin

Add comment