বন্দনা মিত্র, ১৯৮৬ মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
মেয়ে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে, হোস্টেলে থেকে পড়তে।
মা বড়সড় স্যুটকেশ কিনেছে, গুছিয়ে দিচ্ছে, একটা একটা পছন্দের জামা, ক্লাসে পরার, রাতে পরে ঘুমোনোর, বন্ধুদের সঙ্গে শপিং, সিনেমা যাওয়ার – ঠাঁই কম, গুণে গুণে সাতদিনের সাতটা, একটা দুটো বাড়তি।
গুছিয়ে দিচ্ছে মেয়ের প্রিয় পারফিউম, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, সাবান, জুতো – ঘরে পরার, বাইরে পরার।
- বোরোলীন নিয়েছিস? ডেটল?
মনে পড়ছে মেয়ের গরমকালে র্যাশ বেরোয়, ওষুধটা সবজায়গায় পাওয়া যায় না – বাড়তি দুটো টিউব দিতে হবে। সাইনাসেও প্রায়ই কষ্ট পায়। আর খুব জ্বর হচ্ছে ইদানিং ঠান্ডা গরমে। প্যারাসিটামল, মাথা ধরার ওষুধ, ভিক্স। সর্দির ওষুধটা দেখে দিতে হবে। আবার ঘুমিয়ে না পড়ে অসময়ে।
- বেগুনে অ্যালার্জি, বেগুন হলে হস্টেলে শুধু ওর একার জন্যে অন্যকিছু রান্না করবে কি? না করলে!
- মেয়ে বিছানার বড় চাদর ভাঁজ করতে পারে না, শিখে যাবে অবশ্য। মশারীও টাঙাতে পারে না, মশার ধূপে আগুন ধরলে?
- পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পরা অভ্যেস, কে তুলে খাওয়াবে? রুমমেটকে বলে রাখিস কিন্তু, রাতে তোকে সঙ্গে নিয়ে যেন খেতে যায়।
- মার্কসিট, দরকারী ডকুমেন্টস, নিয়েছিস সব? পাসপোর্ট সাইজ ফোটো? আধার কার্ড?
এক এক করে মিলিয়ে দেখে নেয় মা লিস্টের সঙ্গে।
- এ টি এম কার্ডের র কোডটা যেন দিস না কারোকে।
- চাবি সাবধান, যেন না হারায়।
- হিসেব করে টাকা তুলবি।
- ঠিক মত খাবি, ইচ্ছে না করলেও যা দেবে খেয়ে নিও – ওটা হস্টেল, বাড়ি নয়। মনে রাখতে হবে। পাউরুটি মাখন কিনে রেখো, হোস্টেলের খাবার পছন্দ না হলে খাবে।
- মোবাইল ফুল রিচার্জ করা হয়েছে তো? রোজ নিয়ম করে সকাল সন্ধ্যে ফোন করবে।
মায়ের মনে পড়ে মেয়ে চুলের জট ছাড়াতে পারে না। আবার ঘুমের ঘোরে বালিশ থেকে মাথা নেমে যায়,ঠিক মত তুলে না দিলে, সকালে অবধারিত স্টিফ শোল্ডার। ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলে ঘুমোতে পারে না। যদি রুমমেট রাত জেগে পড়াশুনো করে তাহলে কি হবে? আলো জ্বালা নিয়ে রুমমেটের সঙ্গে ঝগড়া করিস না যেন, চোখে চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়িস।
এই তো সেদিন কানের ব্যথায়, এত বড় মেয়ে, কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল। গ্যাস ওভেনে চাটু বসিয়ে তোয়ালে গরম করে সারা রাত সেঁক দিয়ে দিয়ে তবে ঘুমিয়েছে। যদি হোস্টেলে রাতে কান ব্যথা করে?
- তোয়ালের কথায় মনে পড়ল, রোজ ঠিকমত সব ইনারস আর তোয়ালে কাচবি, তুই যা কুঁড়ে! ও বাবা, কাচবি তো শুকোবি কোথায়? কাপড় মেলার তার কিনতে হবে তো, আর এক ডজন ক্লিপ। নেলকাটার নিয়েছিস? সেফটিপিন?
যাকে বলা তিনি তখন হোয়াটস অ্যাপে চ্যাটে ব্যস্ত – বন্ধুরা একই ট্রেণে দল বেঁধে যাচ্ছে, সীট নাম্বার আদান প্রদান হচ্ছে, কোন স্টেশনে নেমে চা আর পুরি সবজি খাওয়া হবে প্ল্যান চলছে। খুব রাগ করতে গিয়ে হঠাত মার মন কেমন করে উঠছে, মনে পড়ছে সেই সাগরে সুপুরীডোঙা ভাসানোর গল্প,
“পৃথিবীর যেখানে যে আছো ভগবান
আমার বাছার তরে দিলাম এই দুব্বো ধান।“
ঠাকুমা’র ঝুলির দুয়োরাণী মা থেকে আজকের সুপার মম, মায়েরা একই রয়ে গেল, তাদের আর মর্ডান হওয়া হল না !
Add comment