মানস ঘোষ, শ্রী শিশির কুমার ঘোষ (বিই কলেজ PWD Electrical) -র পুত্র
সেই কোন ছোটবেলার কথা। পাড়ার দুর্গাপূজার মন্ডপে, মায়ের কাছে শিখেছিলাম, ঠাকুরের কাছে হাতজোড় করে প্রার্থনা করতে হয়।
কি প্রার্থনা করতে হয় ? মা বলেছিলেন, যে যা চায়, সেটাই ঠাকুরের কাছে চোখ বুজে, হাত জোড় করে, মনে মনে বলতে হয়। অবোধ শিশুর মনে ভয়ানক খটকা লেগেছিল। তখনো পর্যন্ত তার চাওয়া, আবদার, প্রশ্রয়, সবকিছুই তো মায়ের কাছে, মায়ের স্নেহের আঁচলের ছায়াটুকুই তার জগৎ। আর কোথাও যে কিছু চাওয়া যেতে পারে ভাবতে পারার মত বয়স তখনো আমার হয়নি।
যুগে যুগে সব মায়েরাই বোধহয় চোখ দেখলে মনের কথা পড়তে পারেন। বললেন, – ” ঠাকুরকে বোলো, সবার ভালো হোক!” আমিও আধো আধো স্বরে বললেম, “ঠাকুর, সবার ভালো কোরো! ”
সেই শুরু, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত, মন্দিরে হোক বা মন্ডপে যখনই কোনো দেবদেবীর মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, এছাড়া আর অন্য কিছু বলিনি বা বলা ভালো, বলতে পারিনি। মাঝের এতগুলো বছরে বহুবার বিপদে দিশাহারা হয়েছি, হতাশার অন্ধকারে ডুবে গেছি, প্রেমে আর প্রেমহীনতায় পথ হারিয়েছি, কখনো কিছু পাবার আশায় উদ্বেল হয়েছি, কখনো বা নিকটজনের অসুস্থতা বা মৃত্যুশোক এসে গ্রাস করেছে আমার সমস্ত অস্তিত্ব। কতবার এমন হয়েছে, বিপদের সমাধান প্রার্থনা করব মনস্থ করে দেবীপ্রতিমার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু হাত জোড় করে যেই চোখ বন্ধ করতাম, দেবীমূর্তি যেন বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াত, তাঁর সেই পরম কল্যাণময়ী রূপ ভুলিয়ে দিত আমার জাগতিক চাওয়া পাওয়ার সব হিসেব, মনে মনে শুধু বলতাম, ” হে ভগবান, সবাইকে ভালো রেখো ! ”
প্রায় বছরকুড়ি আগে মা কে প্রায় অনুযোগের সুরেই বলেছিলাম একথা,
– “সেই যে তুমি আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলে, তারপর থেকে কিছুই চাইতে পারি না আর… “। মা এর উত্তরে বলেছিলেন, ” এর চেয়ে আর বেশী কিই বা চাওয়ার আছে? সবাই ভালো থাকলে তবেই তো আমি ভালো থাকব। ”
শুনে, শ্রদ্ধায় আনত হয়েছিলাম, ভক্তিতে আপ্লুত হয়েছিলাম। মুখে কিছু বলতে পারিনি, শুধু একটা প্রণাম করেছিলাম।
তারপর আরো অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নিয়ত পরিণত হয়েছি। ২০১৬ সাল। কালের অমোঘ নিয়মে মা তখন রোগশয্যায়, (তারপর আর মাত্র কয়েকমাস মা আমাদের মধ্যে ছিলেন)।
বাড়ির সামনেই ৯’এর পল্লীর দুর্গাপূজা। অনেক আগে থেকেই ঠিক করেছিলাম, এবারের পূজোয় মায়ের আরোগ্য প্রার্থনাই হবে আমার একমাত্র চাওয়া।
অষ্টমীর অঞ্জলির পর করজোড়ে প্রার্থনা করছি, চোখ বন্ধ করেই দেখতে পেলাম, সমস্ত জগতসংসারব্যাপী এক কল্যান মূর্তি, খুব চেনা, ঠিক যেন আমার মায়ের মতনই,
তাঁর বরাভয় হস্ত থেকে বেরোনো আলো ছড়িয়ে পড়ছে সমস্ত চরাচরে, সেই আলোর ব্যাপ্তি থেকে বাদ পড়িনি আমরা কেউই, বাদ পড়েনি জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনো জীবই। অস্ফুটে শুধু বললাম, “জগতের ভালো কোরো মা”।
পরে মনে মনে নিজের অসুস্থ মা’কে বলেছিলাম, “ক্ষমা কোরো মা, হয়তো তোমার শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হতে পারিনি বলেই স্বার্থপরের মতো, কেবল তোমার আরোগ্য চাইতে পারলাম না। আর কার কাছেই বা চাইব? তুমিই তো আমার সেই সর্বংসহা কল্যাণময়ী জগজ্জননী! “
Add comment