সঞ্জয় বসু, ১৯৯০, আর্কিটেকচার ও প্ল্যানিং
মানুষ ভালো বা মন্দ, যাই হোক না কেন, জীবনে কোনো দ্বন্দ্ব বা হতাশা আসেনি, এরকম হয় না।
মানুষ তখন ধর্মগুরু, বন্ধুবান্ধব, পরিবার কে আঁকড়ে ধরে। তাদেরকেই ধরে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে।
যারা একটু একা, বা অন্তর্মুখী, তারা অনেকে কবি বা দার্শনিকদের উক্তি মনে মনে উচ্চারণ করে নিজের মনকে শক্ত করে। নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক।
অদ্ভুতভাবে, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, অ্যারিস্টটল, মেকিয়াভেলি, মার্কাস অরেলিয়াস, ৎসুণ-সু বা লেনিনের উক্তির আগে মায়ের কথাই মনে পড়ে বেশি।
নিজের চোখে দেখা, কানে শোনা, হৃদয়-মন দিয়ে জাপটে ধরে রাখা একটা মানুষ কিনা, তাই! নয়ত কি আর আমার মা এইসব মনীষীদের নখের যুগ্যি?
মায়ের কিছু পেটেন্ট ডায়ালগ আমার জীবনের পাথেয় হয়ে আছে।
সেই ছেলেবেলায়, আমি “অমুকটা দেবে বলেছিলে, কবে দেবে” বলে বেশি জেদ করলে, আর মা সেটা দিতে না পারলে, এক নিশ্বাসে বলত,
– “বলেছি, ভুল করেছি, বেশ করেছি, আর বলবো না, কি করবি কর!”
অফিসে বা ব্যবসায় কখনো কারো কথার খেলাপে আঘাত পেলে, এই কথাটা তখুনি মনে আসে। এক নিমেষে হতাশা চলে যায়, মুচকি হেসে প্রসঙ্গ পাল্টাই।
মা যদি আমায় কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারে, অবস্থার চাপে অন্যদেরও সেরকম হতে পারে। জোর করে আদায় করতে গেলে, জিনিসটা হয়ত পাবো, মানুষটাকে হারাতে হতে পারে।
পরীক্ষা খারাপ হয়েছে, বা বন্ধুর সাথে ঝগড়া, অফিসের চাপে ‘হেরে যাচ্ছি’ মনে হচ্ছে, মুখ বাংলার পাঁচের মত করে হয়ত কোনায় বসে আছি, মা বললে,
– “মরে মরে বেঁচে লাভ কি?”
কিম্বা,
-“বেঁচে নে, বেঁচে নে আগে। মরা তো আছেই একদিন। মরে মরে বাঁচবি কেন?”
যারা আমায় চেনে, তারা বুঝবে হয়ত, আমার সদাই টকবগে ছটফটে স্বভাবের মূল হয়ত এখানেই। বেঁচে থাকাটাই একটা সেলিব্রেশন!
বাবা বাড়ীতে থাকত না বেশিরভাগ সময়।
১৯৪৯ সালে বি. ই. কলেজ থেকে সিভিল নিয়ে পাস করেছিলেন। জীবিকার সন্ধানে নানা দেশে মাঠে ঘাটে ব্যস্ত থাকত। মা একা সংসারে জটিল কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে নিজেকেই নিজে সাহস যোগাত,
– “মরুঙ্গি, পর হারুঙ্গী নহি!”
আমিও সংসারে অসম সমরের সন্মুখীন হলে মনে মনে আওড়াই,
“মরুঙ্গা, পর হারুঙ্গা নহি”!
কোনো সাংঘাতিক শক্ত কাজ, যেটা সাধরনত পুরুষরাও করতে ভয় পাবে, সেটায় মা ঝাঁপিয়ে পড়ত অক্লেশে। যেমন একবার বাড়ির পাশে অন্ধকার ঝোপের মধ্যে সরসর আওয়াজ শুনে সাপ সন্দেহে লাঠি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে এসে, ঠাট্টার সুরে বললে, (নিজেকে তর্জনী দিয়ে ইঙ্গিত করে)-
-“খুব লড়ি মর্দানি! ডর গই, পর পিছে ন হটি!”
চার ফুট দশ ইঞ্চির একটা মহিলার মধ্যে এই বেপরোয়া ভাবটা, সাহস না বোকামির ইঙ্গিত, সেটা তর্ক বাহুল্য। ‘ভয় পেয়েছি ‘ এই উক্তি ততটাই স্বাভাবিক ছিল মায়ের কাছে, যেমন ছিল সেটাকে পার করে কর্তব্যে অটুট থাকার মনোবল। ছেলেপুলের বাড়িতে সাপ ঢোকার আগে মা’কে পার করতে হবে, এই ভাব। তাই দরজা জানালা বন্ধ না করে, সাপের পেছনে তাড়া করাটাই মায়ের কাছে স্বাভাবিক! সাপটা সেদিন ঝামেলা না বাড়িয়ে দেওয়াল বেয়ে পিছনের সাহেব বাগানে পগার পার।
দিল্লি অঞ্চলে মায়ের জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশুনো ইত্যাদি। সেখানে মর্দানি কথাটা এসেছে ‘ মরদ’ থেকে। মরদের সমকক্ষ হয়ে সন্মান আদায় করে যে ‘অউরত’, তাদের বলে ‘মর্দানি’ !
মাঝে মধ্যে কাজের ফাঁকে বাবা বাড়িতে আসলে ছুটির দিনে লুডোর বোর্ড পাতা হতো। বাবা একদিকে দুই হাতের চাল দিত, মা আর আমি প্রতিপক্ষ। বাবার হাতে দনাদন ছক্কা পড়ত। এত ছয় পড়ত যে মনে হত যে কিছু গন্ডগোল করছে। ছক্কা পাল্টে, চাল দেবার ছোট্ট পাত্রটা পাল্টে, বাঁ হতে চাল দিতে বাধ্য করে, কিছুতেই বাবার ছয় ফেলা আটকাতে পারি নি।
মায়ের হাতের চাল একদম বিপরীত। দেবতারা এক বা দুইয়ের বেশি মায়ের কপালে লেখেন নি। আমাদের ঘুটি ঘর থেকে বেরোবার আগেই বাবার অর্ধেক ঘুটি পেকে যেত। আমার ভাগ্যের হাত ছিল মোটামুটি। মিলিয়ে মিশিয়ে যা হয় একটা পড়ত।
বাবার এই বিষম ছয় ফেলার প্লাবনে আমাদের কখনোই জেতার কথা নয়। কিন্তু মায়ের ঘুটিগুলোকে জোড়া, তিন জোড়া করে করে বাবার ঘুটির রাস্তা আটকানোর অভিসন্ধির ফলে বাবা হেরে যেত অনেক সময়ই। তিন জোড়া ঘুটি টপকাবার জন্য দরকার কমপক্ষে তিনটে ঘুটি। বাবার দিকে হয়ত তখন দুটোই ঘুটি বাইরে। বাকি সব উঠে গেছে। শেষ ঘুটিটা পেকে উঠে যেতে বাবার যখন এক বা দুই দরকার, বাবা তখনও সমানে ছয় ফেলে চলেছে! সেই মাইডাস এর গল্প আর কি!
একটা ঘুটি জন্য শেষে হেরে গিয়ে বাবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো।
মা কাঁধ মাথা ঝাকিয়ে, ভুরু নাচিয়ে হেসে হেসে বলত,
– সমঝে বঙ্গালী ইঞ্জিনিয়ার বাবু, “ম্যে পঞ্জাব দি কুড়ি”, মেহনত অর অকল সে জীত হাসিল করতে হেঁ, তকদির কে সাহারে নহি!
মায়েরা বাঙালিই ছিল। কিন্তু জন্ম দিল্লিতে, আর দিল্লিতে সেকালে পঞ্জাবের প্রভাব ছিল খুব প্রখর। মা নিজেকে “পঞ্জাব দি কুড়ি” বা ‘পঞ্জাবের কন্যা’ হিসেবে ভাবতে ভালবাসত।
সেখান থেকেই মায়ের পাওয়া এই দিলখুশ ‘লড়কে লেঙ্গে দুনিয়া’ মেজাজ। মায়ের লুডো খেলা থেকে পাওয়া আমার শিক্ষা – ভরসা রাখা উচিত প্রচেষ্টায়, ভাগ্যে নয়। শেষ দানের আগে অব্দি যে লড়াই জারি রাখা উচিত, সেটার ট্রেনিং হয়েছে মায়ের সাথে লুডো খেলে।
একটা অদ্ভুত ব্যাপার, না বলে পারছিনা। বাবা অসম্ভব মেধাবী বুদ্ধিমান লোক ছিল। দাবা আর ব্রিজ খেলায় ওস্তাদ। কিন্তু কখনো মায়ের এই জোড়া করে প্রতিপক্ষের রাস্তা আটকাবার পদ্ধতি, বাবাকে প্রয়োগ করতে দেখিনি। সেটা নীতিবোধ থেকে, নাকি নিজের ছক্কা-ভাগ্যের ওপর অটুট বিশ্বাস থেকে, বুঝতে পারতম না তখন। ওই রকম ছয় পড়ার সাথে যদি বাবা আমাদের গুটিগুলোকেই জোড়া করে আটকাতে শুরু করতো, তাহলে আমরা কোনো কালেই জিততে পারতাম না। এখন মনে হয়, কোনোটাই নয়। এটা বোধহয় ছিল বাবার ভালোবাসা জনিত আত্মসম্বরনের প্রকাশ। মা বোধ হয় বুঝতে পারতো না। দিল্লির মেয়ে!
ইংরেজি, হিন্দি আর পাঞ্জাবির অনায়াস আনাগোনা ছিল মায়ের ঠোঁটে। মারাঠি বলত ভালই। একটু তামিলও বলতে শুনেছি চেন্নাইয়ে ট্রান্সফার হয়ে এসে। ভাষা বিভ্রাটের দরুন প্রথম কয়েকটা মাস যে আমাদের দুর্বিষহ হয়ে ওঠেনি, সেটা খানিকটা মায়ের টুকরো টুকরো তামিল ভাষায় ম্যানেজ দেবার জন্য।
স্কুলের টিচারি, টুইশন, বাড়ির কাজ সামলে, মা গল্প বই পড়ার সময় পেত না বিশেষ। পড়লে বাংলাই পড়ত। আমি অসুস্থ হয়ে শুয়ে থাকলে পাশে বসে স্কুলের পড়া শোনাত, ইংরেজি, বাংলা, বিজ্ঞান বা ভূগোল বই থেকে। কানের মধ্যে গেঁথে যাওয়া একবার করা সে পাঠ আমার বছর শেষের পরীক্ষায় ৬৫% আনার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। এই থেকেই আমার জীবনে ৬৫% টার্গেট করার ফিলোসফি। এটুকু হলেই দিব্যি হেসে খেলে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। যারা ১০০% এর জন্য দৌড়চ্ছে, তাদের দিকে তাকাই, আর মনে মনে শুভেচ্ছা জানাই। ওই রাস্তা আমার নয়।
আমার পাঠ্য গল্পে এক অসুস্থ মৃত্যমুখ ছেলের ‘এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না” পড়তে পড়তে মা কেঁদে ভাসাল। আমি চির রুগ্ন। আমার অগতির আশঙ্কায় হয়ত কেঁপে উঠল মায়ের বুক। লেঠেল মায়ের সন্তান স্নেহ এতটুকু কম নয়। বাঘিনীর অপত্য স্নেহ আর কি!।
নানা অসুখের মধ্যে শুয়ে শুয়েই মায়ের কাছে আমার প্রথম গান শোনা। অন্ধকারে অসুস্থ হয়ে শুয়ে থাকলে মায়ের গলায় সে গান আজও কানে রিনরিন করে।
– পাঞ্চজন্য! শোন শোন সবে, আসিলরে ভগবান!
– দোষ করো নয় মা! আমি স্বখাত সলিলে..
– যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই পথে।
– আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠনা ফুটে মন।
বাংলা ছাড়া অন্য কিছু গাইতে শুনি নি কখনো। জন্ম থেকে বড় হয়ে ইংরেজি মিডিয়ামে মাস্টার্স ডিগ্রী অবধি পড়া দিল্লির এক মহিলার এই বাংলা প্রেম, সে বেশ একটা ব্যাপার আমার কাছে।
আজ মা নেই। মায়েরা থাকে না। তবু আবার বুকের ধুকপুকের মধ্যে থেকেই যায়। আছে। থাকবে শেষ হৃতস্পন্দন অবধি।
এক দিকপাল বলে গেছেন,
‘রণে বনে জলে জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়িবে,
আমাকে স্মরণ করিও। আমি রক্ষা করিব ‘
ভালো বলেছেন মহাশয়।
কিছু মনে করবেন না। আমি কিন্তু, রণে বনে জলে জঙ্গলে যখনই বিপদে পড়ি, মা নিজেই স্মরণে আসে, ডাকতে হয় না। সেটাই তো স্বাভাবিক, নাকি? আপনাদেরকে যে ডাকতে হয়! মা তো নিজেই আসে। আর কারোকে যে আপন করে চিনি না, মায়ের মত!
মা অবশ্য আপনাদের পায়ের নখের যুগ্যি নয়, প্রথমেই তো মেনেছি সেই কথা!
আমি তখন কিছুই বলতে পারতাম না..কিন্তু মা, তুমি আমার মনের সব কথা বুঝে নিতে। আর আজ আমি বড় হয়ে অনেক কথাই লুকানোর চেষ্টা করি, আর বলি, এসব তুমি বুঝবে না! কিন্তু আমি জানি মা, তুমি সবই বুঝতে পারো। আই লাভ ইউ মা।
The best place to cry is in a mother’s arms. – Jodi Picoult
All that I am or ever hope to be, I owe to my angel mother – Abraham Lincoln
It’s a funny thing about mothers and fathers. Even when their own child is the most disgusting little blister you could ever imagine, they still think that he or she is wonderful. – Roald Dahl
At the end of the day, my most important job is still mom-in-chief. – Michelle Obama
A mother’s love is the fuel that enables a normal human being to do the impossible. – Marion C. Garretty.
Being a single parent is twice the work, twice the stress, and twice the tears but also twice the hugs, twice the love, and twice the pride – Unknown
There are no goodbyes, wherever you are, you will always be in my heart. – Mahatma Gandhi
Add comment