সাহিত্যিকা

নারীচেতনা, পৌরাণিক ভারতে – সোহম দাশগুপ্ত

সোহম দাশগুপ্ত, ১৯৭৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

ভারতবর্ষের সমাজে নারীর অধিকারের বিষয়ে ভাবনা ও বিতর্ক দুটোই প্রাচীন। মহাভারতের কাল থেকেই ইতিহাসে, সাহিত্যে এই বিষয়ে সমাজের অন্তঃসলিলা টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়। আমাদের কল্পনায় নারী একাধারে তেজস্বিনী, শক্তির প্রতিমূর্তি, আবার কখনো সর্বংসহা ধরিত্রীর গুণধারিণী। কখনো সে আয়ুধ সজ্জিতা অসুরবিনাশীনি, আবার কখনো অভিশপ্ত শিলাময়ী অহল্যার বেশে, শ্রীরামচন্দ্রের পদস্পর্শের প্রতিক্ষারতা। ভারতীয় দর্শনে নারী তার মাতৃত্বের গৌরবে কখনো শ্রেষ্ঠ আসনে অধিষ্টিতা, আবার কখনো ব্যবহারিক জীবনে পুরুষের সাথে ক্ষমতায় অসম প্রতিদ্বন্দীতায় ভুলুন্ঠিতা। এই বৈপরীত্বের দোলাচলে দীর্ঘকাল ধরেই নারী সমাজ  এক“ন যযৌ, ন তস্থৌ”, অবস্থায় বিমূঢ়!

আজ যখন আধুনিক পৃথিবী মহা সমারোহে “বিশ্ব নারী দিবস” পালন করছে, তখন আমার এই প্রাচীন ভারতের উল্লেখে অনেকেই বিস্মিত হতে পারেন। তাই এখানে দুটি বিখ্যাত ভারতীয় মহাকাব্যে এক ঐতিহাসিক নারী চরিত্রর কথা স্মরণ করাতে চাই। দুই মহাকাব্যে এই বিশেষ চরিত্রটিকে অনুধাবন করলে নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ভারতীয় পুরুষ সমাজের প্রচ্ছন্ন মনস্তত্ব কিছুটা আন্দাজ করা যায়।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই অসামান্যা চরিত্রটি হলেন, মহারাজা ভরতের গর্ভধারিণী, বিশ্বামিত্র তনয়া শকুন্তলা। আনুমানিক প্রায় দু’হাজার বছর আগে মহাভারতের আদিপর্বের অজস্র প্রচলিত আখ্যানকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ মহাকাব্যটি প্রথম লিপিবদ্ধ করা হয়। তাই ধরে নিই শকুন্তলা ও আনুসঙ্গিক চরিত্রগুলির মধ্যে তৎকালীন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিফলন পাওয়া যাবে। কাহিনীটির সাথে অনেকেই সুপরিচিত তাই অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিই।

মৃগয়ার সমাপন করিয়া রাজা দুষ্যন্ত গভীর অরণ্যে মহামুনি কণ্ব’র আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। তাহার কন্ঠস্বর শুনিয়া এক প্রস্ফুটিত যৌবনা, অপরূপা আশ্রম-কন্যার আবির্ভাব ঘটিল। সেই কাঞ্চনবর্ণা, কাজলনয়না ললনা মহাসমাদরে রাজা দুষ্যন্তকে আপ্যায়ন জানাইলেন। সেই সময়ে ঋষি কণ্ব ফলাদি সংগ্রহ করিতে বাহির হইয়াছিলেন। আলাপ পরিচয়ের পর্ব কাটিতে না কাটিতেই দুষ্যন্ত সেই উদ্ভিন্ন যৌবনা, তিলোত্তমার রূপে-গুনে মুগ্ধ হইয়া তাহাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। সলজ্জ শকুন্তলা সসম্ভ্রমে মহারাজাকে ঋষি কণ্বের প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষার অনুরোধ জানাইলেন। প্রেমজর্জর দুষ্যন্ত তখন ধৈর্য ধরিতে অপারগ। তিনি আবেগ মথিত কন্ঠে শকুন্তলাকে নানা বাক্যালঙ্কারে ভূষিত করিয়া, মহামূল্য উপঢৌকনের প্রলোভন দেখাইয়া, তৎক্ষণাৎ গান্ধর্ব বিবাহের সম্মতি চাহিলেন। তথাপি ধর্মশীলা আশ্রমকন্যার এমত বিবাহে কুন্ঠা দেখিয়া রাজা দুষ্যন্ত অধীর হইয়া উঠিলেন। বিবিধ প্রকার বিবাহের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পূর্বক ঐ মুহুর্তে দু’জনার গান্ধর্ব বিবাহের যাথার্থ প্রমান করিতে সচেষ্ট হইলেন।

ধৈর্য ভরে দুষ্যন্তর সমস্ত কথা শুনিয়া শকুন্তলা শান্ত কন্ঠে কহিলেন, “তাহাই যদি ধর্মের অনুশাসন হয়, তবে এই মুহুর্তে, অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে, আমিই আমার সম্প্রদানকর্ত্রী। অতএব হে পুরুকুল-অধিপতি, আপনি আমার শর্তাবলী শ্রবণ করুন এবং তাহা পূর্ণ করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হউন। এই মিলনে আমি যে পুত্র ধারণ করিব, সে’ই হইবে আপনার একমাত্র উত্তরাধিকারী। হে রাজন, এই আমার অনড় সিদ্ধান্ত। আপনি সম্মতি জানাইলে এখনই আমাদের মিলন হইতে পারে।“ মহারাজ দুষ্যন্ত বিনা কালক্ষেপে শকুন্তলার প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

এই হল মহাভারতের শকুন্তলা ও রাজা দুষ্যন্তের মিলন কাহিনী। যৌবনবতী সুন্দরী হওয়ার পাশাপাশি এই শকুন্তলা এক আত্মসম্ভ্রমী, যুক্তিবাদী, সবলা নারী। রাজাধিরাজের সৌর্য, পরাক্রম, প্রলোভন কিছুই তাহাকে বিচলিত করেনা। নিজের ও ভাবি পুত্রের অধিকার সম্বন্ধে সে সচেতন এবং তা প্রকাশেও কুন্ঠাহীন। একই সাথে তিনি মহারাজের প্রতিজ্ঞার প্রতিও আস্থাশীল। বিস্মিত হয়ে উপলব্ধি করি যে আজ থেকে দু’হাজার বছর আগেও স্ত্রী পুরুষের সম্পর্কের মাঝে রূপ, গুন, ক্ষমতা, মর্যাদার সাথে সাথে  যুক্তি, বুদ্ধি, ধর্ম, আবেগের মত অন্যান্য  মানবিক গুনাগুনও সমান মর্যাদা পেতো।  এবার আসি ঐ একই শকুন্তলাকে নিয়ে রচিত আরেক কাহিনীতে। আনুমানিক চারশো থেকে পাঁচশো খৃষ্টাব্দে রচিত মহাকবি কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলমে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – চিত্রশিল্পী রাজা রভি ভার্মা

 

কবি কালিদাসের শকুন্তলা কিন্তু মহাভারতের শকুন্তলা থেকে বহুলাংশে ভিন্ন। এই শকুন্তলাও সদ্যযৌবনা, অনন্যা সুন্দরী কিন্তু চারিত্রিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। সে যুক্তিবুদ্ধির চেয়ে অনেক বেশী নির্ভরশীল আবেগের ওপরে। হয়তো নাটকের চাহিদাতেই দুই সখী অনসূয়া আর প্রিয়ংবদার প্রগল্ভ প্রশংসায় তার অনাবিল মন অন্ধ রোমান্টিকতায় মোহাচ্ছন্ন। তাই দুষ্যন্তের রাজকীয় আবির্ভাব এবং প্রেমার্ত আবেদনে সে মুহুর্তেই অভিভুত। অচিরেই দুষ্যন্তর কাছে তার নিঃশর্ত আত্মনিবেদন এবং মিলন ঘটল। তার জন্য দুষ্যন্তকে কোনো শপথ নিতে হয়না, কারণ শকুন্তলা মিলনের উপহার হিসেবে শুধু মাত্র একটি রাজ অঙ্গূরিয় পেয়েই তৃপ্ত ও আশ্বস্ত। এই অভিজ্ঞান শকুন্তলম শুধুমাত্র রাজসভাতে বা দেশের সম্ভ্রান্ত মহলেই মহাকাব্যর মর্যাদা পায়নি, এর নাট্যরূপটি  সমাজের নানা স্তরে আদৃত হয়। আন্দাজ করতে পারি, এই শকুন্তলায়  পাঁচশো খৃষ্টাব্দের ভারতীয় পুরুষ সমাজের কাঙ্খিত নারীর রূপটি প্রতিফলিত হয়েছিল।

 

মহাভারত ও কালিদাসের নাটকে একই চরিত্রের এই গুনগত বৈপরীত্য শুধু মিলনের সময়েই নয়, পরবর্তী কালে রাজসভা পর্বেও প্রকট।

 

মহাভারতের শকুন্তলার যথাকালে পুত্র সন্তান প্রসব করেন। দীর্ঘকাল তাদের প্রতিপালন কালে মহামুনি কণ্ব ঐ সৌর-তেজদীপ্ত বালকের গুনাবলী লক্ষ্য করিয়া বিস্মিত হইলেন। যথাকালে তিনি শকুন্তলাকে হস্তিনাপুর গমন করিয়া পুত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিলেন। তাহার আজ্ঞা অনুযায়ী শকুন্তলা পুত্র সহ রাজা দুষ্যন্তর রাজসভায় উপস্থিত হইলেন। অতঃপর যথাযথ ভাবে রাজবন্দনা সারিয়া তিনি পুত্রের পরিচয় প্রকাশ করিয়া তাহাকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করার অনুরোধ জানাইলেন। সেই অসামান্যা নারীর দর্শনে ও বাচনে প্রথমে দুষ্যন্তর স্মৃতি উদ্ভাসিত হইল বটে, কিন্তু পরমুহুর্তে তিনি শকুন্তলাকে চিনিতে অস্বীকার করিলেন! উপরন্তু তাহাকে “দুষ্টা” আখ্যা দিয়া অবিলম্বে রাজসভা ত্যাগ করিবার আদেশ দিলেন! অপমানিত শকুন্তলা তখন বজ্রাহত। ধীরে ধীরে তাহার চক্ষু যুগল তাম্র বর্ণ ধারণ করিল।  ওষ্ঠদ্বয় কাঁপিতে লাগিলো। অন্তরের সন্ন্যাসিনীর তেজ হোমানলের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল। কিন্তু এক অসামান্য ক্ষমতা বলে তিনি আপন অন্তরেই সেই অগ্নিকে নির্বাপিত করিলেন। অতঃপর সেই অকুতোভয় নারী সভাসমক্ষে শান্ত অথচ সুদৃঢ় কন্ঠে দুষ্যন্তকে নিতান্ত “নীচ”, “প্রবঞ্চক”, “পাপিষ্ঠ” ইত্যাদি আখ্যা দিলেন। সূর্য, চন্দ্র, মরুৎ, অগ্নি, মেদিনী, আকাশ, দিবস, রাত্রি, উষা, সন্ধ্যা এবং তৎসহ যম ও ধর্মকে সাক্ষ মানিয়া তিনি জায়া ও সন্তানের জননী রূপে সম্মান ও স্বীকৃতির দাবীতে এক জোড়ালো বক্তব্য পেশ করিলেন। ক্ষিপ্ত দুষ্যন্ত এবার শকুন্তলার জন্ম বৃত্যান্তর আড়ালে মেনকা ও বিশ্বামিত্রর অবৈধ রতি সম্ভোগের প্রসঙ্গ টানিয়া তাহাকে অযাচিত কন্যা ও চরিত্রহীনা রূপে প্রতিপন্ন করিতে সচেষ্ট হইলেন। শকুন্তলার সমস্ত ধৈর্যের অবসান ঘটিল। তিনি ঘোষণা করিলেন, “হে রাজন, একদিন আপনাকে সত্যের সম্মুখীন হইতে হইবে। আপনার সাহচর্যর আর কোনো প্রয়োজন আমার নাই। আমি নিজেই পথ খুঁজিয়া লইব। সেই দিন সমাসন্ন, যখন আমার এই পুত্র সসাগরা পৃথিবীর অধিশ্বর হইবে।“ আর বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করিয়া তিনি পুত্র সহ রাজসভা ত্যাগ করিলেন। শকুন্তলার প্রস্থানের অব্যবহিত পরেই দুষ্যন্ত এক দৈব বাণী শুনিলেন, এবং তৎক্ষণাৎ মত পরিবর্তন করিয়া স্ত্রী পুত্রকে ফিরাইয়া আনেন ও সমাদরে গ্রহণ করেন।  অতঃপর সেই পুত্রের নাম রাখেন ভরত।

 

এই হল মহাভারতে হস্তিনাপুর রাজসভায় শকুন্তলার অভিজ্ঞতার কাহিনী। এবার কালিদাসের নাটকের রাজসভা পর্বে আসা যাক।

 

ঋষি কণ্বের পরামর্শ অনুযায়ী ঋষিপত্নী মাতা গৌতমী এবং দুই শিষ্যর সাথে অন্তঃসত্বা শকুন্তলা হস্তিনাপুরে গমন করেন। অবগুন্ঠিতা হইলেও শকুন্তলার অসামান্য রূপরশ্মী দুষ্যন্তকে মুহুর্তে মোহিত করিয়া তুলিল। তিনি মাতা গৌতমীর কাছে রমণীর পরিচয় জানিবার আগ্রহ প্রকাশ করিলেন। শকুন্তলার অন্তর রোমাঞ্চে শিহরিত হইয়া উঠিল। মহারাজের সাথে তাহার নিবিড় প্রেমের মুহুর্তগুলি স্মৃতিতে ভাসিয়া উঠিল। তিনি করযুগল বক্ষে চাপিয়া সমস্ত আবেগ সম্বরণ করিয়া রহিলেন। ঋষি কণ্বের শিষ্য মুনি স্বর্ণগর্ভ কুশল বিনিময় পর্ব সারিয়া দুষ্যন্তর কাছে অবগুন্ঠিতার পরিচয় প্রকাশ করিলেন এবং ঋষি কণ্বের পরামর্শ অনুযায়ী তাহাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করার অনুরোধও জানাইলেন। সে কথা শুনিয়া মহারাজ যেন আকাশ হইতে পড়িলেন! তিনি ঋষি স্বর্ণগর্ভকে তীব্র ভর্ৎসনা করিয়া এমন সম্পর্ককে সর্বৈব মিথ্যা অপবাদ বলিয়া দাবী করিলেন! মহারাজের সন্দেহ নিরসন করিতে মাতা গৌতমী শকুন্তলাকে অবগুন্ঠন মুক্ত করিলেও দুষ্যন্ত মানিলেন না। উপরন্তু শকুন্তলা ইতিমধ্যে উপহারের অঙ্গুরীয়টি হারাইয়া ফেলিয়াছে শুনিয়া সভামধ্যে শকুন্তলাকে চরম অপমান করিতে লাগিলেন। তাহাকে কুহকিনী, মিথ্যাচারিণী, স্বার্থসন্ধানী নারী বলিয়া সম্বোধন করিলেন। সর্বসমক্ষে সেই অপমানে শকুন্তলা যেন তড়িতাহত, বাকরুদ্ধ, স্থাণুবৎ! এহেন পরিস্থিতিকে তিনি অদৃষ্টের পরিহাসে ভাবিয়া আপন অন্তরেই রোদন করিতে লাগিলেন! অবশেষে মর্মাহত মাতা গৌতমী যখন পালিতা কন্যার হাত ধরিয়া রাজসভা ত্যাগ করিতে উদ্যত, ঠিক তখনই স্বামী পরিত্যক্তা, অন্তঃস্বত্তা শূন্যপানে দু বাহু তুলিয়া আহ্বান জানাইতেই এক বিদ্যুত শিখা  নামিয়া আসিল। শকুন্তলা সেই অসীম তেজপুঞ্জের মাঝে বিলীন হইলেন।

 

মহাভারতের বর্ণনায় এ কথা স্পষ্ট যে দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে চিনতে পেরেও না চেনার ভাণ করেছিলেন। তার সেই অনৈতিক আচরণের পেছনে হয়তো একটা আশঙ্কা ছিল যে তৎকালীন সমাজ ঐ সম্পর্ককে বৈধতা দেবেনা। তাই একদিকে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা আর অন্যদিকে সমাজের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য কাহিনী রচয়িতা অবশেষে দৈববাণীর সাহায্য নিলেন। তা সত্বেও মহাভারতে  রাজা দুষ্যন্তের অনৈতিক আচরণকে আড়াল করার প্রচেষ্টা হয়নি।

 

এবার আসি অভিজ্ঞান শকুন্তলমের আখ্যানে। ইতিমধ্যেই কাব্যিক স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে কবি শকুন্তলার কাহিনীতে দুর্বাশা মুনির আবির্ভাব ঘটিয়ে বেচারীর জীবনকে অভিশপ্ত করে দিয়েছেন।  তারপরেও প্রশ্ন জাগে, দুষ্যন্ত যদি শকুন্তলাকে সম্পূর্ণ  ভুলে গিয়েই থাকতেন, তাহলে উপহারের কথা তার মনে পড়লো কি করে? কালিদাসের কাহিনী অনুযায়ী, এই ঘটনার কিছুদিন বাদেই এক মৎস্যজীবী মাছের পেট থেকে রাজ অঙ্গুরীয়টি উদ্ধার করে রাজসভায় নিয়ে আসে। সভাসদদের সমুখে মহারাজের আর সত্য গোপনের উপায় থাকেনা। স্বভাবতঃই রাজা দুষ্যন্ত নিজের বিস্মৃতি জনিত অন্যায়ের শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন! কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তৎক্ষণাৎ সেই অন্যায়ের কোনো প্রতিকার হয়না! কালিদাসের কাহিনী অনুযায়ী, বহুকাল বাদে কোনো এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাগমনের পথে রাজা দুষ্যন্ত আবার ঋষি কণ্বের আশ্রমে পদার্পন করেন। সেখানেই চিরপ্রতীক্ষারতা শকুন্তলা ও তার কিশোর পুত্রকে দেখে রাজার ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। এতোদিন পরে হঠাতই শকুন্তলার সাথে ঘোর অবিচারের গ্লানি তার বিবেকে কষাঘাত করে। অবশেষে প্রতিকার হিসেবে তিনি মহাড়ম্বরে স্ত্রী, পুত্রকে নিয়ে হস্তিনাপু্রে ফিরে আসেন।

 

এখানে সহজেই লক্ষ্য করা যায় যে মহাভারত ও অভিজ্ঞান শকুন্তলম রচনাকালের মধ্যবর্তী সময়কালে ভারতীয় মানসিকতায় নারী পুরুষের সম্পর্কের সমীকরণে বিস্তর ফারাক ঘটে গেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান কবি গ্যেটের অনুবাদের মাধ্যমে ইউরোপের সমাজে কালিদাসের শকুন্তলা হয়ে উঠলেন আদর্শ ভারতীয় নারীর প্রতীক। এই শকুন্তলা রূপে মোহিনী, স্বভাবে পবিত্র, প্রেমে নিঃশর্ত এবং প্রতীক্ষায় অপরিসীম ধৈর্যশীলা। স্বাভাবিক ভাবেই ভিক্টোরীয় ধ্যান ধারণায় সদ্য প্রভাবিত ভারতীয় শিক্ষিত মহলও এই কালিদাসের শকুন্তলার মধ্যেই খঁজে পেলেন তাদের আদর্শ নারীকে। পুরুষ শাসিত সমাজের চোখে মহাভারতের শকুন্তলা সুন্দরীই শুধু নয়, তৎসহ যুক্তিবাদী ও আত্মাভিমানী। তাই তিনি পুরুষের মনে সমীহর উদ্রেক করলেও তার প্রতিবাদী চরিত্র ও আপোষহীন মনোভাব সমাজের উদবেগের কারণও বটে। অবশ্যম্ভাবী ভাবেই এই শকুন্তলা ঢাকা পড়েন ইতিহাসের আস্তরণে, বিস্মৃতির অতলে!

 

আশ্চর্যজনক ভাবে গত দুই শতাব্দীর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভারতীয় নারী সমাজ অগোচরেই এই দুই শকুন্তলার সমস্ত গুনগুলিকে আহরণ করে তার এক অভিনব অভিব্যাক্তি দিয়েছে। আজ জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারী তাদের সংসারে শুধু নয়, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে এমনকি সামাজিক আন্দোলনের একেবারে সমুখের সারিতে বিরাজমান। একথা অনস্বীকার্য যে প্রকৃত অর্থে সমাজে সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার বহুকাঙ্খিত লক্ষ্য এখনো বহুদূর। আবার আশার কথা হচ্ছে, আধুনিক ভারতের পুরুষেরাও দিনে দিনে আরও বেশী সংখ্যায়  নারীসমাজের এই আন্দোলনে শুধু সমর্থনই নয়, সামিলও হচ্ছেন। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বহু শতাব্দী ধরে যে উদ্যোগ ছিল বহুক্ষেত্রেই বিচ্ছিন্ন অথবা অন্তঃসলিলা আজকের এই নারী আন্দোলন তাকে আগামী দিনে আরও সংহত ও  সংগঠিত করে এগিয়ে নিয়ে যাবে নব নব পূর্বাচলে, আলোকে, আলোকে।

 

Sahityika Admin

Add comment