সাহিত্যিকা

জানা / অজানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ধারাবাহিক) – দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

সংকলক: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৮১ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সারা জীবনে বহু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। জীবনে বহু শোক-তাপও পেয়েছেন, কিন্তু কখনই আশাহত হন নি।। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর সাহিত্যে, তাঁর চিঠিপত্রে এবং তাঁর বিশাল কর্মকান্ডে। তাঁর জীবনের কয়েকটি ঘটনার কথা ধারাবাহিক ভাবে তুলে ধরলাম।

 

চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায়, গানে, সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়, শিক্ষায় ও দার্শনিক ভাবনায় জগতের কাছে যতটা পরিচিত, চিত্রশিল্পী হিসাবে বোধহয় ততটা নন। জীবনের শেষ লগ্নে অর্থৎ শেষ সতেরো-আঠারো বছর (১৯২৩-১৯৪১) তিনি অবিরাম ছবি এঁকে গেছেন। সমগ্র ছবির সংখ্যা প্রায় ২৩০০, যেখানে গীতবিতানের হিসাব অনুযায়ী, আজীবন ধরে তাঁর রচিত অজস্র ধারায়, গানের সংখ্যা ২২৩২। যদিও সংখ্যা দিয়ে কিছু প্রমাণ হয় না, তবে তাঁর আঁকার প্রবল গতিবেগ বুঝতে সাহায্য করে। আধুনিক চিত্রকলার ইতিহাসে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।

 

সেই কবে ১৮৯৩ সালের ১৭ জুলাই, রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রের একটি চিঠিতে ইন্দিরাদেবীকে লিখছেন : “ওই যে চিত্রবিদ্যা বলে একটা বিদ্যা আছে তার প্রতিও আমি হতাশ প্রণয়ের লুব্ধ দৃষ্টিপাত করে থাকি – কিন্তু আর পাবার আশা নেই, সাধনা করবার বয়স চলে গেছে।” আবার দেখা যায় ১৯১৬ সালে জাপান থেকে তাঁর কন্যা মীরাদেবীকে চিঠিতে লিখছেন: “আমার যেটুকু সাধ্য ছিল আমি তো করতে প্রস্তুত হলুম কিন্তু কোথাও তো প্রাণ জাগল না। চিত্রবিদ্যা তো আমার বিদ্যা নয়, যদি তা হত তা হলে দেখাতুম আমি কি করতে পারতুম।” রবীন্দ্রনাথের এই সব চিঠি থেকে একটা বিষয় বোঝা যায় যে শুরু থেকেই চিত্রবিদ্যার প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল।  ১৮৯৪ সালের ১৩ জুলাই একটি চিঠিতে (ছিন্নপত্রাবলী) লিখছেন: “… সেই জন্য আমার মনে হয় বিশুদ্ধ আর্ট হচ্ছে ছবি ও গান – সাহিত্য নয়। মানুষের ভাষা, মানুষের তুলি এবং কণ্ঠের চেয়ে ঢের বেশি মুখর বলে সাহিত্যে আমরা অনেক জিনিস মিশিয়ে ফেলি – সৌন্দর্য প্রকাশের উপলক্ষে খবর দিই, উপদেশ দিই, নানা কথা বলে নিই।” জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও সেই একই কথা।  ১৯৩৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী অমিয় চক্রবর্তীকে এক পত্রে লিখছেন: “বাক্যের সৃষ্টির উপর আমার সংশয় জন্মে গেছে। এত রকমের চলতি খেয়ালের উপর তার দর যাচাই হয়, খুঁজে পাই না তাঁর মূল্যের আদর্শ। ..এই টলমলে অবস্থায় এখনকার মতো দুটো পাকা ঠিকানা পেয়েছি আমার বাণপ্রস্থের – গান আর ছবি।”

 

আজীবন রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন বিশুদ্ধ আর্ট হচ্ছে ছবি ও গান। বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীরা বলে থাকেন তাঁর প্রতিটি গানের মধ্যেই যেন ফুটে উঠেছে একের পর এক অজস্র ছবির ধারা। তবে তাঁর সাহিত্য যে ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে প্রচারিত হয়েছিল (রচনাবলী, বিভিন্ন বই, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদির মাধ্যমে) ছবির ক্ষেত্রে সেভাবে তখন হয় নি। অবশ্য ‘রবীন্দ্র চিত্রাবলী’ গ্রন্থটি প্রকাশের পর সেই অভাব এখন অনেকটা মিটেছে। বিশ্বভারতী, প্রতিক্ষণ প্রকাশন ও ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের যৌথ উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষের অন্যতম কার্যক্রম হিসাবে, ২০১১-র মে মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে চার খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে ‘রবীন্দ্র চিত্রাবলী’। এটি সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক আর. শিবকুমার। এই গ্রন্থে মুদ্রিত ছবির সংখ্যা ২০৬৩; ছবিগুলি বিষয়ানুগভাবে সাজানো হয়েছে। প্রথম খন্ডে রয়েছে ‘Erasures I Images’ বা পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি ছবি। তারপর ‘Manuscript 123’ বলে রবীন্দ্রভবনে সংগ্রহের একটি খাতায় আঁকা ছবি। এছাড়া ‘Animals I Composites I Patterns’ শিরোনামে আর একটি বিভাগের অন্তর্গত ছবি। দ্বিতীয় খন্ডে রয়েছে ‘Masks I Faces’ এবং ‘Portraits I Characters’ – মূলত মুখোশ ও মুখাবয়বের ছবি। তৃতীয় খন্ডে ‘Figures I Gestures’ এবং ‘Motifs I Moments’ – মূলত মানুষী অবয়বের ছবি। চতুর্থ খন্ডে এসেছে ‘Landscapes I Flowers’ – মূলত ফুল, ড্রয়িং ও ইলাস্ট্রেশনের রৈখিক ছবি। প্রতিটি বিভাগের ছবি আবার কালানুক্রমে সাজানো হয়েছে।

 

তাঁর প্রথম ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৩০ সালের ৩০ মে প্যারিসের গ্যালারি পিগাল-এ (Gallerie Pigalle, Paris)। কলকাতায় তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে। তার কিছুদিন বাদে ১৯৩২-এর ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর একটি প্রদর্শনী। তবে ১৯২৮ সালের ৮ই অক্টোবরে নির্মলকুমারী মহলানবীশকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকে মনে হয় তাঁর ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল শান্তিনিকেতনের কলাভবনে। তিনি লিখেছেন: ” পরশুদিন কলাভবনে হবে চিত্র প্রদর্শনী – অধিকাংশ আমার – শুনে হাসবে –  হাসলে অন্যায় হবে না – কিন্তু একলাই বা হাসবে কেন, সর্বসাধারণকে হাসবার সুযোগ দেওয়া উচিত।”

 

রবীন্দ্রনাথের ছবির আলোচনা করার ক্ষমতা বা অধিকার কোনোটাই আমার নেই। একটা মজার গল্প বলে লেখাটা শেষ করি। রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের সেবক মহাদেব একবার একটি কান্ড ঘটিয়েছিল। একদিন গুরুদেবের টেবিল ঝাড়পোঁছ করতে গিয়ে, কাগজের তলায় রাখা রঙের বাটি উল্টে ফেলে। রবীন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটি ছবি এঁকে উঠে গিয়েছিলেন। সেই রঙের বাটি উল্টে, পাঁচ-ছ’খানা ছবির গায়ে রং লেগে একাকার হয়ে গেল। মহাদেব ভয়ে আধমরা। নিশ্চয় আজ তার চাকরি থেকে জবাব হয়ে যাবে। মহাদেব এক দৌড়ে অনিলবাবুর (সেই সময় শান্তিনিকেতনে কর্মরত রবীন্দ্রনাথের এক সহচর) কাছে গিয়ে সব জানালো। অনিলবাবু খুব সাবধানে মহাদেবের কান্ডটি ধীরে ধীরে গুরুদেবকে জানালেন। আরও বলেন মহাদেব খুব ভয় পেয়ে গেছে। মহাদেব তখন দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁপছে। সব শুনে গুরুদেব বলে উঠলেন, ভয় পাচ্ছে কেন? ওর কী দোষ। আমারই ভুলে রঙের বাটিটা ওখানে ছিল। বলো ওকে, ভয় নেই ওর। মহাদেব কাছে এগোলে বললেন, সব সময় খেয়াল থাকে না, ওখানটা ঝাড়পোঁছ একটু সাবধানেই করিস। মহাদেব আনন্দে আত্মহারা।

কি আঁকা ছিল সেই পাঁচ-ছ’টা নষ্ট হয়ে যাওয়া ছবিতে? কেউ জানে না। যিনি জানতেন তিনি আজ আর নেই।

*********

 

নোবেল প্রাইজ

গ্রেট ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচারের সদস্য হিসাবে ব্রিটিশ কবি Thomas Sturge Moore (১৮৭০ – ১৯৪৪) রবীন্দ্রনাথকে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করে সুইডিশ আকাদেমির কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। সেই সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবে রবীন্দ্রনাথের রচনা ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একটি কথাও ছিল না। যদিও স্ট্রার্জ মূর সুইডিশ আকাদেমির কাছে পরিচিত ছিলেন এবং হয়তো এই প্রস্তাবে কিছু অভিনবত্ব ছিল যার কারণে এটি সুইডিশ আকাদেমির চোখে পড়ে ও প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। নোবেল কমিটির সদস্য পের হ্যালস্ট্রম [Per Hallstrom, ১৮৬৬-১৯৬০] উপর দায়িত্ব এল এই প্রস্তাবটির গ্রহণযোগ্যতা বিচার করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য। রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময় সীমা বেঁধে দেওয়া হল ২৯শে অক্টোবর ১৯১৩।

 

হ্যালস্ট্রম কিন্তু সময় সীমাকে পাত্তা না দিয়ে অনেক সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করতে নামলেন – হাতে সম্বল বলতে রবীন্দ্রনাথের ইংরাজি গদ্যে অনুবাদিত গীতাঞ্জলি (Gitanjali/Song Offerings) গ্রন্থটি সঙ্গে W. B. Yeats এর ভূমিকা। গীতাঞ্জলি গ্রন্থ সম্বন্ধে হ্যালস্ট্রমের রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায় : ‘the small collection of poems…creates such a surprisingly rich and genuinely poetic impression that there is nothing odd or absurd in the proposal to reward it even with such a distinction as it is a question here……something more remarkable than anything that European poetry has to offer at present.’

এরপর হ্যালস্ট্রম দেখলেন এজরা পাউণ্ড ও আর্নেস্ট রীজ লিখিত গীতাঞ্জলির সমালোচনাগুলি। তিনি বহু কষ্টে জোগাড় করলেন সদ্য প্রকাশিত (Oct, 1913) রবীন্দ্রনাথের নিজের (ক্ষণিকা, খেয়া, মানসী, উৎসর্গ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত) ইংরাজি অনুবাদিত কবিতাগুচ্ছ “The Gardener”.  হ্যালস্ট্রম এই প্রেমকবিতাগুলির মধ্যেও সৌন্দর্যের কোনো অভাব দেখতে পান নি। রিপোর্ট শেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন : ‘It is certain, however, that no poet in Europe since the death of Goethe in 1882 can rival Tagore in nobles humanity, in unaffected greatness, in classical tranquillity.’

 

কিন্তু হ্যালস্ট্রমের এই রিপোর্টে কাজ হলো না। Harald Hjärne [১৮৮৪-১৯২২] সভাপতিত্বে গঠিত নোবেল কমিটিতে রবীন্দ্রনাথের নাম অনুমোদিত হয়নি। হেয়ার্নের বক্তব্য :’…it must be difficult to decide how much in Tagore’s enchanting poetry was his own personal creation and how much must be attributed to the classical traditions of Indian literature. Therefore, the Committee gave serious consideration in the first place to another author who had been proposed, Emile Faguet [1847-1916], the French literary historian and moralist.’ কি বলবেন বলুন?

 

সুইডিশ আকাদেমিতে একজন বাংলা জানা সদস্যও ছিলেন। তিনি হলেন বৃদ্ধ প্রাচ্যবিদ্ Henrik Vilhelm Tegnér [১৮৪৩-১৯২৮]।  কিন্তু তিনিও কমিটির সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারেন নি। আসলে সেবার বাঘা বাঘা সাহিত্যিকদের নাম কমিটির সামনে প্রস্তাবিত হয়েছে, যেমন ইংল্যান্ড থেকে Thomas Hardy [১৮৪০-১৯২৮], ফ্রান্স থেকে Pierre Loti [১৮৫০-১৯২৩], Ernest Lavisse [১৮৪২-১৯২২], Anatole France [১৮৪৪-১৯২৪] – সব মিলিয়ে ২৮ জনের নাম প্রস্তাবিত হয়।

 

সব শেষে রবীন্দ্রনাথের সমর্থনে উদ্যোগ নিলেন সুইডেনের সমসাময়িক বিখ্যাত কবি এবং সুইডিশ আকাদেমির সদস্য Carl Gustaf Verner von Heidenstam [১৮৫৯ – ১৯৪০]। ইংরাজি গীতাঞ্জলি ও Andrea Butenschön-কৃত সুইডিশ অনুবাদ পড়ে তিনি মুগ্ধ হলেন। তাঁর নিজস্ব কবিপ্রকৃতির প্রতিফলন তিনি দেখলেন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে। তিনি আকাদেমির সদস্যদের উদ্দেশে লিখলেন :  ‘I was deeply moved when I read them and I do not remember having read any lyric writing to equal them during the past twenty years or more. They gave me hours of intense enjoyment, it was like drinking water of a fresh, clear spring. The intense and loving piety that permeates his every thought and feeling, the purity of heart, the noble and natural sublimity of his style, all combine to create a whole that has a deep and rare spiritual beauty. There is nothing vain, worldly and petty, and if ever a poet may be said to posses the qualities that make him entitled to a Noble Prize, it is he…..Now that we have finally found an ideal poet of really great stature, we should not pass him over. For the first time to come, it would be vouchsafed us to discover a great name before it has appeared in all newspapers. If this is to be achieved, however, we must not tarry and miss the opportunity by waiting till another year.’

 

এবারে কর্তারা গুরুত্ব অনুধাবন করলেন। এরপরের প্রতিবেদন এই রকম : ‘More and more of the Academicians began to read Gitanjali and gradually succumbed to the charm of those rhythmic ideas. Then the unexpected happened. The Committee’s recommendation in behalf of Emile Faguet was rejected by a decision of the Academy in pleno. Of the thirteen who voted on November ’13, twelve were in favour of Rabindranath Tagore. ‘Stockholm, Thursday, Nov 13’ [২৭শে কার্তিক] তারিখ দিয়ে খবরটি সেদিনই ঘোষিত হয়: ‘The Nobel Prize for literature for 1913 has been awarded to the Indian Poet Rabindra Nath Tagore.

 

এরপর তো সবই  ইতিহাস। শুধু বলে রাখি, পরের বছর অর্থাৎ ১৯১৬ (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯১৪ ও ১৯১৫ নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় নি) Carl Gustaf Verner von Heidenstam সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুবাদিত ছোটদের কবিতার বই ‘The Crescent Moon’ উৎসর্গ করেছিলেন টমাস স্টার্জ মূরকে এবং তাঁর অনুবাদিত ‘The Gardener’ গ্রন্থটি W. B. Yeats কে উৎসর্গ করেন।

***********

 

উপবাসী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৩১তম জন্মদিনে, প্রসিদ্ধ লেখিকা প্রিয়ম্বদা দেবী* (১৮৭১ – ১৯৩৫), একটি বাঁধানো নোটবই উপহার দেন।  উপহারটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে রবীন্দ্রনাথ এতে ‘সোনার তরী’ ও ‘চিত্রা’ কাব্যের অনেকগুলি কবিতা লিখে রেখেছিলেন। এটি মূল পাণ্ডুলিপি নয়, অন্য কোনো খসড়া খাতা থেকে বোধহয় তিনি নকল করেছিলেন। হয়তো বা প্রিয়ম্বদা দেবীর অনুরোধেই। সে যাই হোক, কিন্তু নোট বইয়ের প্রথম পাতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন মহাকবি গ্যোটের একটি বাণী : Entbehren sollst du, sollst entbehren. Goethe. গ্যোটের এই বাণীটির বিশদ ব্যাখ্যাও রবীন্দ্রনাথ করেছিলেন।

 

কুষ্টিয়া (এখন বাংলাদেশে) থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি চিঠিতে (৬ই, অক্টোবর, ১৮৯৫) ইন্দিরাদেবীকে লিখছেন : ” Goethe-র একটি কথা আমি মনে করে রেখে দিয়েছি – সেটা শুনতে খুব সাদাসিধে, কিন্তু আমার কাছে বড়ো গভীর বলে মনে হয় – Entbehren sollst du, sollst entbehren [অর্থাৎ] Thou must do without, must do without. কেবল হৃদয়ের আহার নয়, বাইরের সুখস্বাচ্ছন্দ্য জিনিষপত্রও আমাদের অসাড় করে দেয় – বাইরের সমস্ত যখন বিরল তখনি নিজেকে ভালোরকমে পাওয়া যায়। সেই জন্যে কলকাতার অপেক্ষাকৃত স্বাচ্ছন্দ্য আমাকে অল্পকালের মধ্যেই পীড়ন করতে থাকে, সেখানকার ছোটোখাটো সুখসম্ভোগের মধ্যে আমার যেন নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে।“ ****

 

রবীন্দ্রনাথের চিঠিটির আর কয়েকটি অংশ তুলে ধরতে বড় ইচ্ছে হল। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন : ” —– জীবনে অনেকবার অনেকদিন উপবাসী থেকে অনেক দুঃখব্রত উদযাপন করেছি – সেই তপস্যার ফলেই বিশ্বজগতের অনন্ত রহস্যময় গভীরতা আমার সম্মুখে প্রায় সর্বদাই সমুদ্রের মতো প্রসারিত হয়েছে। হৃদয়ের প্রাত্যহিক পরিতৃপ্তিতে মানুষের কোনো ভালো হয় না, তাতে প্রচুর উপকরণের অপব্যয় হয়ে কেবল অল্প সুখ উৎপন্ন করে, এবং কেবল আয়োজনেই সময় চলে যায় – উপভোগের অবসর থাকে না। কিন্তু ব্রতযাপনের মতো জীবনযাপন করলে দেখা যায় অল্প সুখও প্রচুর সুখ এবং সুখই একমাত্র সুখকর জিনিষ নয়। চিত্তের দর্শন স্পর্শন শ্রবণ মনন – শক্তিকে যদি সচেতন রাখতে হয়, যা-কিছু পাওয়া যায় তাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করবার শক্তিকে যদি উজ্জ্বল রাখতে হয়, তা হলে হৃদয়টাকে সর্বদা আধ-পেটা খাইয়ে রাখতে হয় – নিজেকে প্রাচুর্য থেকে বঞ্চিত করতে হয়। *****

 

– তার পরে জীবনে সর্বতোভাবে সুখী না হয়েও চরিতার্থ হয়ে মরা যেতে পারে। – Entbehren sollst du, sollst entbehren ”

********

 

প্রথম অনুবাদ

আচ্ছা বলতে পারবেন কে প্রথম রবীন্দ্রনাথের তিনটি ছোটগল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন? ইনি আর কেউ নন স্বয়ং সিস্টার নিবেদিতা। যতদূর জানা যায় যে ১৯০০ সালে, সিস্টার নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথের তিনটি ছোটগল্প অনুবাদ করেছিলেন। সেগুলি হল ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’ ও ‘দানপ্রতিদান’। স্যার জগদীশচন্দ্র বোস ও তাঁর স্ত্রী অবলা বোস এই অনুবাদের কাজটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে নিবেদিতাকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেন। ১৯০০ সালের ২৯এ নভেম্বর, একটি চিঠিতে নিবেদিতা তাঁর বন্ধু মিসেস ওলি বুলকে (Mrs. Ole Bull, ১৮৫০-১৯১১) লিখছেন: “The Cabuliwallah and Leave of Absence are both Englished now, and I have ‘Giving and Giving in Return’ ready for the last finish. So we are doing something.” সুতরাং রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের প্রথম অনুবাদিকা নিশ্চয় সিস্টার নিবেদিতা। দুর্ভাগ্য যে ‘কাবুলিওয়ালা’ ছাড়া আর বাকি দুটি অনুবাদ এখন আর পাওয়া যায় না।

**********

 

মণিহারা

১৮৯৯ সালে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রফেসর বিপিনবিহারী গুপ্তকে বলেন কি ভাবে তিনি প্রায় একরকম বাধ্য হয়েই ‘মণিহারা’ ছোটগল্পটি লেখেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন যে কুচবিহারের মহারানী ভুতের গল্প শুনতে খুব ভালোবাসতেন। একদিন তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন আপনি নিশ্চয় ভুত দেখেছেন। আমাকে একটা ভুতের গল্প বলুন। রবীন্দ্রনাথ যত বলেন যে তিনি জীবনে কখনও ভুত দেখেন নি, কিন্তু রানীমা সে কথা বিশ্বাস করেন নি। বার বার তিনি মাথা নাড়িয়া বলেন যে না আপনি নিশ্চয় ভুত দেখেছেন, একটা ভুতের গল্প বলুন। রবীন্দ্রনাথ এরপর বলেছেন যে আর কোনো উপায় না থাকায় আমাকে মনগড়া ভাঙা পোড়ো বাড়ী, কঙ্কালের খটখট শব্দ ইত্যাদি নিয়ে এসে একটা মনগড়া ভুতের গল্প ‘মণিমালিকা’ (‘মণিহারা’) লিখতে হল। সেই গল্প শুনে রানীমা খুব খুশি হয়েছিলেন।

 

সেই ভুতের গল্প আজ এক ইতিহাস। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ‘তিন কন্যা’ সিনেমায় আমরা ‘মণিহারা’ দেখেছি। এখনও দেখলে বেশ গা ছমছম করে। রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এই ধাঁচের আর একটি ভুতের গল্প লেখেন। গল্পটির নাম হল ‘কঙ্কাল’।

**********

 

রবীন্দ্রনাথ ও নিবেদিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চেয়েছিলেন যে তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ যেন যথেষ্ট শারীরিক ও মানসিক শক্তির অধিকারী হয়। সে যেন জীবনে চলার পথের সমস্ত বাধা, বিপত্তি, দুঃখ ও বেদনা কাটিয়ে উঠতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তখন (১৯০৪) কলকাতায় ছিলেন। সেই সময় অর্থাৎ ১লা, ৩রা, ৫ই আর ৭ই বৈশাখ তিনি কয়েকবার তাঁর বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়ী যান। বোধহয় এর মধ্যে কোন একদিন জগদীশচন্দ্রের বাড়ীতে তাঁর  সঙ্গে দেখা হয় সিস্টার নিবেদিতার। সেখানেই তিনি তাঁর পুত্রের ভ্রমণের একটি ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেন।

 

আসলে নিবেদিতা মনে করতেন যে ভারতবর্ষের যুবক সম্প্রদায় ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থানগুলি দেখবে আর বিশেষ করে হিমালয়ের বিভিন্ন পর্বতমালায় পদব্রজে ভ্রমন করে মহান এই ভারতবর্ষকে জানবে। নিবেদিতা ছিলেন কাজের মানুষ। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। বেলুড় মঠের স্বামীজীদের সঙ্গে দেখা করে কেদার-বদরী ভ্রমণের একটি পরিকল্পনা ছকে ফেললেন। ঠিক হল স্বামী সদানন্দ মহারাজ জনা বারো যুবকদের নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন। নিবেদিতার পরিকল্পনায় স্বামী সদানন্দের ভ্রমণসূচি শোনা মাত্রই রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও ভ্রাতুষ্পুত্র দিনেন্দ্রনাথকে (সুশীলাদেবী ও দ্বিপেন্দ্রনাথের পুত্র) এই ভ্রমণে যোগদান করতে বলেন। ভ্রমণে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারটা আগেই নিবেদিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠিক করে রেখেছিলেন। দলটি ৩রা মে (২১শে বৈশাখ, ১৯০৪) কলকাতা থেকে রওনা হয়।

 

রথীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন, “…গেরুয়া বসন, ঘাড়ে কম্বল, পায়ে ভারী মিলিটারি বুটজুতো – এই অদ্ভুত বেশে আমরা ট্রেনে চাপলুম ও দু-দিন বাদে কাঠগুদামে নামলুম। হরিদ্বারের পথ দিয়েই তীর্থযাত্রীরা সাধারণত কেদারনাথ যায়, কিন্তু সেই রাস্তায় খুব ভিড় হয় বলে স্বামীজী আলমোড়ার পথ দিয়ে যাবেন স্থির করলেন।”

৪ঠা মে, ১৯০৪ সালের একটি চিঠিতে নিবেদিতা মিস ম্যাকলাউডকে (Josephine MacLeod) লেখেন: “Dear Sadananda has taken half a dozen boys to the Hills for a walk. They started yesterday.”

*******

 

তথ্য সংগ্রহ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :

১. রবিজীবনী – প্রথম খন্ডপৃষ্ঠা – ১১৩-১১৪ষষ্ঠ খন্ডপৃষ্ঠা – ৩৭১-৩৭২, – প্রশান্তকুমার পাল। প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।

২. মুজতবা আলী রচনাবলী : পঞ্চতন্ত্র প্রথম পর্বপ্রকাশক : মিত্র ও ঘোষ

৩. রবিজীবনী ষষ্ঠ খন্ড -প্রশান্তকুমার পাল। প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।

৪. বিশ্বপথিক কালিদাস নাগ। প্রকাশক : Writers Workshop

৫. ছিন্নপত্রাবলী (পত্র – ২৩৬) – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক : বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়।

  1. 6. রবিজীবনী (তৃতীয় খন্ড), পৃষ্ঠা ১৭৮, – প্রশান্তকুমার পাল। প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স।

* আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিভা দেবীর বিবাহ হওয়ার সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চৌধুরী পরিবারের ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরী হয়। আশুতোষ চৌধুরীর ভাগিনেয়ী কবি প্রিয়ম্বদা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট স্নেহ করতেন এবং তাঁদের মধ্যে পত্রালাপও ছিল।

৭. রবিজীবনী (চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ২৯৭) – প্রশান্তকুমার পাল। প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।

৮. রবিজীবনী (চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা ২১০) – প্রশান্তকুমার পাল। প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।

৯. রবিজীবনী (পঞ্চম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৭৮) – প্রশান্তকুমার পাল। প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স।

১০. ছবির রবীন্দ্রনাথ – মৃণাল ঘোষ, আভিযান পাবলিশার্স।

১১. কবিকথা – সুধীরচন্দ্র কর, সিগনেট প্রেস।

১২. ছিন্নপত্র – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ।

১৩. Rabindra Chitravali, Catalog, Edited and Introduced by R Siva Kumar. Published by Pratikshan, Kolkata, India, Visva-Bharati, Santiniketan, India, Ministry of Culture, Govt, of India, New Delhi.

১৪. Internet Archive: Digital Library.

Sahityika Admin

Add comment