সাহিত্যিকা

গর্ভধারিণী – ইন্দ্রনীল ঘোষ

ইন্দ্রনীল ঘোষ, ১৯৮৬ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং

সকালে অফিসে বেরোবার সময় মার কাছে গিয়ে বুঝলাম যে, অন্য দিনের চেয়ে অবস্থা আরও খারাপ। প্রায় পাঁচ বছর হল, মা শয্যাশায়ী। পার্কিনসন জনিত জটিল সমস্যা। আগে তুলে এনে সোফায় বসানো যেত। তারপর ক্রমশ অবনতি। গত এক মাস হল, কথাবার্তা বন্ধ, ফ্যালফেলে দৃষ্টি। ডাক্তার জবাব দিয়েছেন। শ্বাসকষ্টের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত আছে। সেটাকেই ফিট করার ব্যবস্থা করে, ছুটলাম অফিসমুখো। বেলা চারটে নাগাদ খবর এল। ছুটে এসে দেখলাম, মা আর নেই।

আজ প্রায় তিন বছর হল, মাকে ছাড়াই বেঁচে আছি। কখনও ভাবতে পারি নি যে, এও সম্ভব। জ্ঞান হবার পর থেকে জানি, মা হল এমন একজন আইডেনটিটি, যার উপরে ভিত্তি করে ধীরে ধারে গড়ে উঠেছে, আমার  অস্তিত্ব। অর্থাৎ এই যে আমি আজ এখনও বর্তমান, এর মূল মোটিভেশন বা উদ্দেশ্য কী? অবশ্যই মা। বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, পরিবার সকলে যতই থাকুন, মাকে বাদ দিয়ে কি কিছু সম্ভব? আর কেনই বা সম্ভব করতে হবে? এতদিনের একটা অভ্যাস, একটা বিশ্বাস, একটা প্রেরণা, মা নেই বলে অমনি দুম্ করে বদলে ফেলতে হবে? বললেই হল যে, এখন থেকে বাকি জীবন মাকে ছাড়াই চলতে হবে। মগের মুলুক নাকি?

মায়ের শয্যা রয়েছে, টিভি রয়েছে, আলমারিতে শাড়ি রয়েছে, ব্যবহৃত জিনিসপত্র রয়েছে, সারা বাড়িতে তার হাতের ছোঁয়া রয়েছে। শুধু মানুষটাই নেই।

আপনি বলবেন, এটাই জগতের নিয়ম। সবাইকেই মেনে নিতে হয়।

সম্প্রতি সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়ের ‘রূহ’ পড়লাম। রূহ শব্দের অর্থ আত্মা। আত্মা যেমন নশ্বর দেহ ত্যাগ করে মহাকালে বিলীন হয়ে যায়, উপন্যাসে তেমনই একজন মা, অনেক লড়াই করেও পরিস্থিতির চাপে শেষ পর্যন্ত তার অসহায় শিশুকে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। যুক্তি হিসাবে দেখানো হয়েছে যে, একদিন না একদিন এটা ঘটতই। মা ও সন্তানের বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। রূহকে একদিন এই শরীর ছেড়ে বেরোতেই হবে।

জানি না বাপু। এখনও দুবেলা মায়ের ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে, মায়ের চোখের দিকে তাকালে, পরিষ্কার মনে হয়, মা আগের মতই কথা বলছে, দৈনন্দিন বিষয়ে। সেই দৃষ্টিতে খুশি, পরামর্শ, এমনকি শাসনও আছে, ঠিক আগের মতোই।

তুমি কোথাও যাও নি, মা। অহর্নিশি আমাদের সঙ্গে আাছো। এটাই সান্ত্বনা যে, তোমার শরীরে আর কোনও ব্যথা বা কষ্ট নেই। জীবনভোর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছো আমাদের মানুষ করতে গিয়ে। হাসিমুখে সব সহ্য করেছো। তাই এখন একদম বিন্দাস আনন্দে থাকবে। মনে রেখো, তুমি এবং আমি, বোন, আমরা সকলে, আসলে একই ‘রূহ’-র অংশ। অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো, ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।

এই যদি সত্য হয়, তবেই এই অস্তিত্বের কিছু অর্থ হয়। অন্যথায় সবই যে তাসের ঘরের মত অর্থহীন।

Sahityika Admin

Add comment