অলকা বসাক, প্রফেসর গোপাল চন্দ্র বসাকের স্ত্রী।
আমার জীবনের অনেকগুলি সেরা দিন বিই কলেজের আশ্রমিক ক্যাম্পাসেই কেটেছে। বিই কলেজের সেরা সময়ে আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম। তেমনি ক্যাম্পাসের কালো দিনগুলোর কথাও মাঝে সাঝে মনে পড়ে। ভালো ভালো স্মৃতির কথা যেমন লিখলাম, তেমনি অনেক দুঃখ নিয়েই কলেজের খারাপ দিনের কথাগুলোও লিখলাম। সব মনে করতে চাইলেও স্মৃতি এখন আর তেমন জোড়ালো নয়, তবু যেটুকু মনে আছে তোমাদের জন্য লিখলাম।
আমার জন্ম ১৯৩০ সালের ১৫ই আগস্ট, মানে এখন আমার বয়স ৯২। দু’দিন পরেই ৯৩ ছুঁই ছুঁই হবে।
বিই কলেজের সাহিত্যিকা পত্রিকার তরফ থেকে যখন আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়, আমি কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। এর কারন আমার ২৮ বছরের ক্যাম্পাস জীবনে দেখেছি, ছাত্ররা তাঁদের স্যারদেরই মনে রেখেছে। কিন্তু মাতৃসমাদের কথা ওরা অতটা ভাবেনি। ব্যাতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। তবে সাধারণভাবে যা উপলব্ধি করেছি, খোলা মনে সেটাই বললাম।
আমার ধারণা যদি সত্যি হয়, তাহলে হয়তো দেখবো এই সাহিত্যিকার পাঠকদের মধ্যে ৯৯ শতাংশই আমার অনুজ। আমি প্রথমেই তোমাদের সকলকে আমার স্নেহ জানাই। তোমাদের অনেককেই হয়তো আমি কলেজের ক্যাম্পাসে দেখেছি, তোমরা আমার সন্তানতুল্য। ২৮ বছরের বিই কলেজের ক্যাম্পাস জীবনে তোমাদের অনেকেই হয়তো আমাদের কোয়ার্টারেও এসেছো, কিন্তু আজ আমি সেই মুখগুলি বা নামগুলি আর মনে করতে পারি না।
১৯৪৯ সালে তোমাদের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর জিসি বসাকের সাথে বিয়ের সুত্রে আমার ক্যাম্পাসে আগমন। আর ১৯৭৭ সালে উনি রিটায়ার করলে আমরাও ক্যাম্পাস ছেড়ে কলকাতার সল্ট লেকে চলে আসি। এখন আমাকে সাহিত্যিকায় বিই কলেজ নিয়ে লিখতে বসলে অনেক স্মৃতি যেমন মনে গেঁথে আছে, তেমনি অনেককিছুই তো আর মনে আসে না। তাই আমি আমার লেখার নাম দিলাম কষ্টকল্পিত, মানে অতীতের ভুলে যাওয়া অনেক কিছুই আমাকে এখন রোমন্থন করে তোমাদের সাহিত্যিকা পত্রিকার জন্য লিখতে হবে।
আমার জন্ম বা ছোটবেলা কেটেছে কলকাতার আশুতোষ মুখার্জী রোডের ২৪ নম্বর বাড়িতে। পড়াশুনার শুরু খিদিরপুরের সেন্ট তেরেসা স্কুলে। তারপর গোখলে। সেখানে এক বছর পড়ে তারপর লরেটো হাউস থেকে সিনিওর কেমব্রিজ পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কত সালে মনে নেই। ঐ যে বললাম, আমার লেখার নাম কষ্টকল্পিত। এরপর আশুতোষ কলেজ থেকে সায়েন্স নিয়ে পাশ করি।
খুব ছোটবেলার একটা কথা অবশ্য মনে আছে। সেটা ১৯৩৭-৩৮ সাল হবে। আমার বাবা তখন কেন্দ্রীয় সরকারের ইনকাম ট্যাক্স কমিশনার। বাবার সাথে আমরা বাড়ির সবাই আফগানিস্তান বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম খাইবার পাস দেখলাম, জানলাম। যদিও আমি খুবই ছোট, তবু মনে আছে, আমাদের মানে ভারতীয়দের, এবং বিশেষ করে মেয়েদের চলাফেরায় অনেক নিষেধাজ্ঞা ছিলো। আফগান সর্দারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে তবেই আমরা রাস্তায় বেড়াতে পারতাম। আর আমরা মেয়েরা তো রাস্তায় নামতেই পারবো না। দুটি ঘটনা মনে আছে। সরকারী ও আফগান সর্দারের অনুমতি নিয়ে আমরা লুকিয়ে বিপ্লবীদের ঘাঁটি দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি কুটিরশিল্পের মতন রাইফেল কামান গোলা তৈরি হচ্ছে। লোহার আকর কোথায় পাবে? না, লাহোর থেকে রেল লাইনের অংশ তুলে নিয়ে এসেছে। সেটা সেই ১৯৩৭-৩৮ সাল, ভাবা যায়? আর দ্বিতীয় ঘটনাটি মনে আছে, ওখানের স্পেশাল রুটি। অবিশ্বাস্য এর সাইজ। আন্দাজ ২০ ইঞ্চি ব্যাস (ডায়ামিটার), আর ৪ ইঞ্চি মোটা এই রুটি একেবারে স্পঞ্জের মতন নরম। আমরা এখন ওটাকেই কেক বলবো। এই রুটি, বা কেক, যাই বলি, একদিনে বানানো যায় না। এই এক একটা রুটি বানাতে সপ্তাহ তিনেক লাগে, আর থাকেও অনেকদিন। আমার মা বলে কয়ে একটা সেই রুটি নিয়ে এসেছিলেন, আর সেটা দু’মাস টাটকা ছিলো।
আমি লরেটো হাউসের ছাত্রী ছিলাম। স্কুলে খুব আনন্দ করেছি। পড়াশনা, খেলাধুলা, ছবি আঁকা, এসব বিষয়ে আমার খুব উৎসাহ ছিলো। সেটা বিয়ের পরেও বিই কলেজ ক্যাম্পাসে এসে চর্চা রেখেছিলাম। পড়াশুনায় লরেটো হাউস থেকে ইন্টার লরাটোর সারা পৃথিবীতে ফোর্থ হয়েছিলাম। ড্রয়িং এ আমার খুব উৎসাহ ছিলো। আমি বিলেতের রয়াল ড্রয়িং এক্সামিনেশনে পাচটা অনার্স পাই। কিন্তু একদম শেষের সিক্সথ এক্সামিনেশন দিতে পারিনি কারন তখন আমি স্কুল পেড়িয়ে কলেজে চলে আসি। লরেটোয় পড়াকালীন আমি টেনিকয়েট, যেটাকে অনেকেই তোমরা রিং টেনিস বলো, সেটায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আর এছাড়াও ইন্টার স্কুল টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল আর বাস্কেটবলও প্রচুর খেলেছি।
৪৯ সালে, আমার বয়স যখন ১৯, আমার বিয়ে হয় আর তার সাথে বিই কলেজ ক্যাম্পাসে আমাদের নতুন সংসারের শুরু। আমার বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন বৈজ্ঞানিক মেঘনাদ সাহা, পশ্চিম বাংলার গভর্নর কাডচু, মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়, ডঃ আর আহমেদ (ডেন্টাল)। মনে আছে, এনারা সকলেই ফুল উপহার দিয়েছিলেন।
বিই কলেজের সেই ৪৯ সালে, স্টাফ ও ছাত্র, উভয়েরই আবাসিক সংকুলানের সমস্যা ছিলো। তখন ক্যাম্পাসে প্রচুর ফাঁকা জায়গা, অনেক হস্টেল আর স্টাফ কোয়ার্টার তৈরি হচ্ছে। হীটন বিল্ডিং এর একটা অংশ ছিলো মুসলিম ছাত্রদের হস্টেল, বাকীটা স্টাফ কোয়ার্টার। প্রফেসর বসাক ছিলেন হীটন হস্টেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট, আর সেখানেই তিনি থাকতেন। আমাদের সংসারের শুরুও হীটন হল থেকে। এখনের প্রজন্ম, শুধু এখনের নয়, ষাটের দশকের থেকে যারা বিই কলেজে পড়েছে, তাঁদের জানাই যে প্রতি রাতে ন’টার সময় তোমাদের বসাক স্যার হীটন হলে রোল কল করতেন। রাত ন’টার পরে কেউ বাইরে থাকতে পারবে না, সেরকমই কড়াকড়ি ছিলো।
এরপর উলফেনডেন হস্টেল তৈরি হলে বসাক স্যার সেখানের সুপারিনটেন্ডেণ্টের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। আর আমরা সেখানের সুপারিনটেন্ডেণ্ট কোয়ার্টারে চলে আসি। সুপারিনটেন্ডেণ্টের একটা সুবিধে ছিলো, কোয়ার্টারের জন্য কোন ভাড়া দিতে হতো না।
ক্যাম্পাসের জীবনের একটা ঘটনা মনে আছে, সেটা ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাস, মানে আমি সবে ক্যাম্পাসে এসেছি, সকলের সাথে সেরকম গভীর পরিচয়ও হয় নি। তোমাদের অরুণ শীল তখন মেটালার্জি ডিপার্ট্মেণ্টের ছাত্র। ওরা ওয়ার্কশপে কাজ করছিলো। তোমাদের বসাক স্যারও ঐখানেই ছিলেন। এমন সময় ব্লাস্ট হয়। খুব সাংঘাতিক প্রাণসংশয়ী দুর্ঘটনা নয়, কিন্তু স্যারের গায়ে আগুন লেগে যায়। ওয়ার্কশপের মেঝে ছিলো মাটির। মাটিও সমতল ছিলো না, একটূ এবড়ো খেবড়ো ছিলো। তখন স্যার ঐ অবস্থায় অন্যদের কাছে আসতে না দিয়ে, নিজে নিজেই হামাগুড়ি দিয়ে (roll করে) মাটির সাথে নিজের শরীর ঘষে ঘষে আগুন আয়ত্তে আনেন। ওর হাতের তালু অনেকটাই পুড়ে গিয়েছিলো। এতটাই যে আমরা তো ভেবেছিলাম এটা ওর চিরস্থায়ী দাগ হয়ে থাকবে। কলেজ থেকেই ওনাকে হাওড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি এই ঘটনা জানতাম না। কেমিস্ট্রি ডিপার্টেমেন্টের তখনের প্রধান প্রফেসর জিপি চ্যাটার্জীর স্ত্রী আমাকে এসে বলেন, কলেজের গাড়ি পেয়েছি, একটা কাজ আছে। আমাকে সঙ্গে যেতে হবে। কোথায় যাবো, কেন যাবো আমাকে বলেন নি। গাড়িতে উঠে তারপর আমাকে বলেন। আমরা দুজনে হাওড়া হাসপাতালে এসে পৌঁছাই আর ঘটনাটা বিস্তারিত জানতে পারি। দেখলাম বসাক স্যারকে চেনাই যাচ্ছে না। আমরা কেবিন চেয়েছিলাম, কিন্তু পাই নি। জেনারেল বেডেই সে ছিলো। তিন কি চার সপ্তাহ ও হাসপাতালে ছিলো, আমরা নিয়মিত হাসপাতালে গিয়ে ওনাকে দেখে আসতাম।
১৯৫০ সালে আমার জমজ ছেলে অরুণ বরুণের জন্ম। ১৯৫১ সালে আমার মেয়ে শুক্লার জন্ম। অরুণ বরুণকে হয়তো অনেকেই চিনবে, কারন তাঁরা দু’জনেই বিই কলেজে পড়াশুনা করেছে। অরুণ বরুণের জন্মের পর থেকেই বিই কলেজ ক্যাম্পাসের সাথে আমার যোগসূত্র আরও বাড়তে থাকে। তখন ক্যাম্পাসের আশেপাশে স্কুল ছিলো না। অথচ বিই কলেজ আবাসিক কলেজ। সেই ক্যাম্পাসে বহু পরিবারের ছোট ছোট শিশুরা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, কিন্তু ক্যাম্পাসে তাঁদের জন্য কোন স্কুলই নেই। তখন আমাদের এই ক্যাম্পাসের মধ্যে স্কুল তৈরি করার পরিকল্পনা হয়, যার ফলস্বরূপ তোমরা এখন বিই কলেজ মডেল স্কুল দেখছো। বিই কলেজের ক্যাম্পাসে এই স্কুল গড়ে ওঠার মূল কাণ্ডারি ছিলেন কলেজের তখনকার, মানে ১৯৫৪ সালের অঙ্ক বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডঃ সুবোধ চন্দ্র চক্রবর্তী। তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে, এখন যেখানে চার্চ, মানে মধুসূদন ভবনের ডানদিকের একতলায় অস্থায়ীরুপে আমরা বাচ্চাদের নার্শারি স্কুল স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমরা ক’জনে মিলে অস্থায়ীরূপে মধুসূদন ভবনের পিছনে হার্ড টেনিস লনে খোলা আকাশের নীচেই ক্লাস শুরু করি। আমার দুই ছেলে অরুণ, বরুণ, প্রফেসর সুবোধ চন্দ্র চক্রবর্তীর মেয়ে মানসী, প্রফেসর হরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর মেয়ে মঞ্জূ, ছেলে সঞ্জু, মিসেস স্টাইন এর দুই সন্তান, মিসেস রানের সন্তান ও ক্যাম্পাসের আরো কিছু বাচ্চাদের নিয়ে শুরু হলো বিই কলেজের একটি নতুন অধ্যায়। শুরু হলো বিই কলেজ ক্যাম্পাসে স্কুলের নার্সারি কেজির ক্লাস। খোলা আকাশের নিচেই মাটিতে মাদুর পেতে সেই স্কুল শুরু হয়েছিলো।
প্রফেসর স্টাইন তখন আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের প্রধান। আমার সাথে ওনার স্ত্রী মিসেস স্টাইন, অঙ্ক বিভাগের প্রধান প্রফেসর সুবোধ চন্দ্র চক্রবর্তীর স্ত্রী, আর মিসেস রানেও পড়াতে রাজী হলেন। অগাধ মনের জোর আর বিশ্বাস নিয়ে আমরা কয়েকজন শুরু করলাম। আমি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়াশুনা করেছি, কিন্তু স্কুলে আমি বাঙলাতেই পড়াতাম। আমাদের প্রয়াস ছিলো পুরোটাই সেবামূলক, এজন্য আমাদের কেউ কোনরকম পারিশ্রমিক নেয়নি।
এরপর আমরা চাইলাম যে পাশেই চার্চে যদি সেই নার্সারি স্কুল চালু করা যায়। যেহেতু সেটি একটি চার্চ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সেখানে স্কুল স্থাপন করতে গেলে চার্চের অনুমোদন লাগে। মিসেস স্টাইন (আর্কিটেকচারের প্রধান প্রফেসর স্টাইনের স্ত্রী) স্কুল গড়ার সম্মতির জন্য চার্চে আবেদন করলেন। ১৯৫৩ সালে স্কুল স্থাপনের জন্য চার্চের সম্মতি এসে গেলে কেজি স্কুলের ক্লাস সেখানেই শুরু হয়ে যায়। এখানেও মাটিতে মাদুর পেতেই ক্লাস হতো। এর বেশি খরচ করার সামর্থ্য আমাদের ছিলো না। প্রথম দিকে অরুণা (প্রফেসর দুর্গাদাস ব্যানার্জির স্ত্রী) ও শ্যামলী (আর্কিটেকচারের প্রফেসর অবনী কুমার দের স্ত্রী) স্কুলের ব্যাপারে নানাভাবে সাহায্য করতেন তবে পড়ান নি। স্কুল ভালোভাবে চালু হয়ে গেলে তখন স্কুলে শুধু আমি, মিসেস স্টাইন, আর মিসেস রানেই পড়াতাম। সেই সময় স্কুলের ছেলেমেয়েদের মাইনে ঠিক হলো মাসে ২টাকা। বাড়ির দুই ছেলেমেয়ে পড়লে মাইনে ছিল ৩টাকা।
এই হলো নার্সারি কেজি স্কুলের গোড়াপত্তন। এরপর ১৯৫৬ সালে বিই কলেজের শতবর্ষের সময় মার্টিন বার্ন কোম্পানিকে অনুরোধ করা হয় আমাদের জন্য একটি পাকা স্কুল বাড়ি তৈরি করে দিতে। স্যার বীরেন মুখার্জী, বিই কলেজের একজন নামী প্রাক্তনী, তখন ছিলেন মার্টিন বার্নের প্রধান। তিনি আমাদের এই প্রয়াসে পুরো সাহায্য করেন। এইভাবেই বিই কলেজের স্কুল ও কলেজ একসূত্রে বাঁধা পড়েছিলো। শুরু হলো পাকাপাকি একটা স্কুল, বিই কলেজের মডেল স্কুল। সেদিনের সেই স্কুলের কোন স্বীকৃতিই ছিলো না। না ছিলো বসার জায়গা, না টেবিল বা ডেস্ক, না তো বোর্ড, বা পাখা। আর মাইনে দিয়ে টিচার রাখা ছিলো সাধ্যের অতীত। কলেজ কর্ত্পক্ষের সাথে আমরা কথা বলি। তখন ওয়ার্কশপ থেকে টেবিল চেয়ার আর ছাত্রদের জন্য ডেস্ক আর চেয়ার এসেছিলো। এইভাবেই স্বল্পসংখ্যক ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের নিয়ে সীমিত ক্ষমতার মধ্যে একটা প্রাইমারি স্কুল তৈরি হলো। প্রথমে এর নাম ছিলো বেসিক প্রাইমারি স্কুল, বা জুনিওর স্কুল, এইরকম কিছু একটা।
তখনও অবধি ক্যাম্পাসের বাইরের কোনো মাস্টারমশাই ছিলেন না। কলেজের প্রফেসরদের স্ত্রীরাই এবং অনেক প্রফেসরও কলেজের ক্লাসের ফাঁকে বিনা মাইনেতেই এখানে পড়াতেন। মায়া (প্রফেসর ভূপাল দত্তের স্ত্রী) পড়াতেন বাঙলা, এপ্লায়েড মেকানিক্স এর প্রফেসর পরেশ নাথ চ্যাটার্জি (পি এন চ্যাটার্জী) পড়াতেন ভূগোল। উঁচু ক্লাসে কেমেস্ট্রি পড়াতেন তোমাদের বসাক স্যার, আর প্রাকটিক্যাল করবার জন্য কলেজের ল্যাবরেটরিতে প্র্যাক্টরিয়াল ক্লাস করাতেন। ফিজিক্স পড়াতেন ডঃ শঙ্কর সেবক বড়াল। অঙ্ক পড়াতেন ডঃ সুবোধ চন্দ্র চক্রবর্তী। তাছাড়া প্রফেসর শরত গাঙ্গুলিও (ম্যাথমেটিক্স ডিপার্টমেন্ট) অঙ্ক করাতেন। প্রফেসর অবনী দেও ভূগোল পড়াতেন।
এবার স্কুলকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলো। ম্যাথমেটিক্স ডিপার্ট্মেন্টের ডঃ সুবোধ চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন পরিচালন কমিটির সভাপতি। উচ্চমাধ্যমিক বোর্ড শর্ত রাখে যে স্কুলে ৫০০০ টাকার রিজার্ভ ফান্ড আছে দেখাতে হবে। তখন পাঁচ হাজার মানে অনেক টাকা। পরিচালন সমিতির বৈঠকে ঠিক হলো চাঁদা তুলেই ফান্ড তৈরি করা হবে। ঐ সমিতিতে তখন আমিই একমাত্র মহিলা মেম্বার।
কিন্তু চাঁদা তোলার ব্যাপারে কেউ এগিয়ে এলেন না। তখন আমি নিজে একাই চাঁদা তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। তিনটি ছোট বাচ্চার মা আমি সংসারের সব কাজ সামলে বেড়িয়ে পড়তাম শুধু কলেজ নয় কলেজের বাইরেও চলে যেতাম সেই হাওড়া ময়দান পর্যন্ত। দুয়ারে দুয়ারে একা একা গিয়ে ফান্ডের টাকা তুলেছিলাম। বলে রাখি, তখন কিন্তু ৫৫ নম্বর বাস বি গার্ডেন পর্যন্ত আসতো না, ব্যাতাইতলা পর্যন্তই আসতো। আমাকে শিবপুর বা হাওড়া ময়দান যেতে হলে ব্যাতাইতলা পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে তারপর বাস ধরতে হতো।
প্রিন্সিপাল অতুল চন্দ্র রায় বলেছিলেন সবচেয়ে বেশী যিনি দেবেন উনি তার দ্বিগুণ দেবেন। সবচেয়ে বেশী অর্থ যোগাড় করেছিলেন প্রফেসর নিমাই নিয়োগী, কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের। মিসেস নিয়োগীর বাবা, রাধা সিনেমার মালিক বলাই বিশ্বাস ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। প্রফেসর এ সি রায় ফান্ডে তার দ্বিগুণ অর্থ দিয়ে নিজের কথা রেখেছিলেন। এইভাবেই ৫০০০ টাকা জোগাড় হয়। উচ্চমাধ্যমিক বোর্ডের শর্তও পূরণ হয়। তারপরই আমাদের মডেল স্কুল উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের স্বীকৃতি পেলো। কলেজের মাস্টারমশাইদের সন্তানরা যারা উঁচু ক্লাসে বাইরের স্কুলে পড়তো তারা অনেকেই এখানে এসে ভর্তি হলো।
ইতিহাস যখন লিখতে বসেছি, তোমাদের আরও কিছু তথ্য দি। ক্লাস ইলেভেন এ কামদাবাবু (প্রফেসর কামদা রঞ্জন মজুমদার) ফিজিক্স পড়াতেন, নন্দিতা (আর্কিটেকচার এর প্রফেসর সলিল ব্যানার্জি স্ত্রী) কেমেস্ট্রি পড়াতো। পরবর্তী কালে ইংরেজি পড়াতেন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্ট্মেন্টের যাদব চক্রবর্তীর স্ত্রী শ্যামলী, আর আর্কিটেকচারের চিত্ত চক্রবর্তীর স্ত্রী শিখা পড়াতো বাংলা। ভূগোল পড়াতো সুমন দাশগুপ্তর স্ত্রী টুটুল।
মডেল স্কুল খানিকটা ভালোমতন চালু হওয়ার পরে ১৯৫৬ সালে আমরা মডেল স্কুলের মধ্যেই ঘর নিয়ে ভারতী স্কুল অফ ডান্স স্থাপন করি। ক্যাম্পাসের মায়েদের কাছে আবেদন করা হয়েছিলো তাঁদের মেয়েদের সপ্তাহে দুটি দিন যেন নাচ শেখাতে পাঠানো হয়। অনেকেই আমাদের আবেদনে সারা দিয়েছিলেন। আবার যখন কলেজের গরমের ছুটি হয়ে যেতো, তখন কলেজের সুইমিং পুলে ছোটদের জন্য সাঁতার শেখার ব্যবস্থা হয়েছিলো।
দুটি স্মরণীয় দিনের কথা মনে পড়ে। এক, ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সচিব নিকিতা ক্রুশ্চেভ ও সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি মার্শাল নিকোলাই বুলগানিন সরকারি সফরে ভারতে আসেন। তৎকালীন বিশ্বের পরম শক্তিধর দেশের দুই সর্বোচ্চ প্রধান তাঁদের সেই ব্যস্ততার মাঝেও বিই কলেজে সরকারী সফরে আসতে রাজি হয়েছিলেন। এমনই ছিলো তখনের বিই কলেজের সর্বভারতীয় সুনাম। আর দুই, ১৯৫৬ সালের বিই কলেজ শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নেহরুজী এসেছিলেন। এই দুটি দিনের কথা আমি আজও ভুলিনি।
ক্যাম্পাসে একটা এরোপ্লেন ছিলো। বিশ্বযুদ্ধের সময় বিই কলেজে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রেনিং দেওয়া হতো। সেই সুত্রে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত একটি এরোপ্লেন ওয়ার্কশপের বাইরে রাখা হয়েছিলো। তখন ঐ এরোপ্লেনে ছাত্রদের ট্রেনিং দেওয়া হতো। যুদ্ধের পরে এই এরোপ্লেন হয়ে গেলো ক্যাম্পাসের একটা বড় আকর্ষন, আর বাইরে থেকে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরা এলে সেই এরোপ্লেন আমরা ওঁদের দেখাতাম।
আরেকটা উল্লেখযোগ্য স্ট্রাকচার, যাকে বলা যায় foundation less model house with hollow bricks. তখনের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান রায় এর উদ্বোধন করেছিলেন।
ঐ সময়ের আরও কয়েকজনের কথা খুব মনে আসে। উইসকনসিন থেকে পিকেট, জর্জিয়ান, এরকম চারজন এসেছিলেন। আমাদের স্টাফেদের সাথে ভালোই মেলামেশা করতেন। পিকেটের স্ত্রী সেলাই এর সরঞ্জাম সঙ্গে এনেছিলেন। আমি খুব যেতাম, কুইল্ট, টি পার্টি, টেনিস, ব্যাডমিন্টন এসেবের মধ্যে দিয়ে অনেকটাই সময় কেটে যেতো।
ব্যাডমিন্টন প্রসঙ্গে মনে পড়ে, দুর্গা ব্যানার্জি নিজের কলেজ জীবনে ভালো ব্যাডমিন্টিন খেলতো, কলেজের চ্যাম্পিয়ন ছিলো শুনেছিলাম। কিন্তু আমার কাছে প্রায়ই হেরে যেতো। উনি প্লেস করলেই আমি রিটার্ন করে দিতাম। আমি স্কুলে খেলাধূলা করেছি, আর তখনও আমার কোর্টে ছোটাছূটির অভ্যাস ছিলো। তাই ছেলেদের বিরুদ্ধেও ভালোই খেলতাম। আমি মিক্সড ডাবলসের চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। আমার পার্টনার কে ছিলো মনে নেই। এখন ক্যাম্পাসের সেই খেলাধূলার দিনগুলোর কথা অনেকটাই ভুলে গিয়েছি, কিন্তু কিছু কিছু কথা এখনও খুবই মনে পড়ে।
প্রথম সরস্বতী পূজো কবে হয়েছিলো, সালটা মনে নেই। তবে এটা মনে আছে, প্রথমবারের পূজোর প্রতিমার অর্ডার দিতে আমি বাসে করে রামরাজাতলায় গিয়েছিলাম। মূর্তি তৈরি হলে বিই কলেজের বিখ্যাত মাইনিং এর বাসে (মুড়ির টিন) করে সেই মূর্তি আনা হয়েছিলো। পুজো হয়েছিলো চার্চের সামনের টেনিস কোর্টে।
একজনকে আমার খুব মনে আছে। ইলা, আমাদের কলেজের প্রথম মেয়ে ছাত্রী। আরেকজন ছিলো, অজানা, কিন্তু সে এখানে বেশিদিন থাকেনি। ইলা আমাদের কোয়ার্টারের কাছেই থাকতো, এখন যেখানে জিমন্যাসিয়াম, সেই বাড়িটির বাঁদিকে। আমাদের সাথে খুবই পরিচিতি ছিলো আর বাড়িতেও প্রায়ই আসতো। তখন মেয়েদের কোনো মেট্রন ছিলো না, আমরাই ওর দেখাশুনা করতাম। আমি বহুদিন ওর রুমে গিয়ে অনেক গল্পগুজব করে এসছি। অত বড় ক্যাম্পাসে হাজার খানেক ছেলের মাঝে একমাত্র মেয়ে, সেইসময়ের হিসেবে ইলা খুবই প্রগতিশীল মেয়ে ছিলো।
এরপর এলো ১৯৬৭-৬৮ সালের নক্সাল আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস। বিই কলেজ ক্যাম্পাসে গন্ডগোল ছিলো মূলত নক্সাল আর সিপিএম এর রেষারেষি, জবরদখল। ডানদিকে নক্সাল, তো বাঁদিকে সিপিএম। কিন্তু আমার কাছে ওরা সকলেই ছাত্র, পুত্রসম। আমি নিজে ওদের অনেকের সাথে কথা বলেছি। ওদের অধিকাংশই ছিলো মেধাবী। কিন্তু কেউ রাজনীতিতে সহজেই ব্রেনওয়াশড, কেউ সহজেই বিপ্লববাদে বিশ্বাস করে। স্বার্থান্বেষী নেতারা এঁদের সহজেই বশ করে বিভ্রান্ত করেছিলো। গোলমালের আরও একটা কারণ, বহিরাগত অনেক পলাতক ছেলে ক্যাম্পাসের হস্টেলে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো। যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে এই হস্টেল, পুলিশ অত সহজে ঢুকবে না, তাই এই হস্টেলগুলো হয়ে উঠেছিলো ওদের নিরাপদ আস্তানা। তবে এটা সম্ভব হয়েছিলো কলেজেরই কিছু ছাত্রের সহযোগীতায়। এই বহিরাগতদের সংখ্যা ছিলো কম, কিন্তু ঐ অল্প কিছু বহিরাগতই কলেজের কিছু ছাত্রের সহায়তায় ভয়ের সন্ত্রাস ছড়িয়ে দিয়েছিলো।
একদিনের ঘটনা, কলেজের ফার্স্ট গেটে পুকুরের পাশে এক ছাত্র রথীন ঘোষকে ধরে অন্যরা মারে। তিনটি গুলি তাঁর গায়ে লাগে, কিন্তু ঈশ্বরের অসীম কৃপায় রথীন গুলি খাওয়া সত্ত্বেও প্রাণে বেঁচে যায়।
আরেকদিন কলেজে নয়, সেকেন্ড গেটের সামনে বাঁশের মাথায় কাটা মুন্ডু নিয়ে কলেজ ঘাট রোড দিয়ে মিছিল হয়েছিলো। ঐসময় একদিন ছেলেরা অরুণ শীলের বাড়িতে হামলা করে। তখন আমার ছেলে দৌড়ে গিয়ে ক্যম্পাসে ইস্টার্ন রাইফেলসকে খবর দিয়ে ডেকে নিয়ে আসে।
আরেকটি দিনের কথা, আমার কাছে বিই কলেজের ইতিহাসের দুর্ভাগ্যতম দিন। তোমাদের ভাষায়, মুচিপাড়ার একটি ছেলেকে সাহেবপাড়ার অন্য পার্টির ছেলেরা পেয়ে জোর করে ম্যাকডনান্ড হলে ধরে নিয়ে যায়। বেচারা ছেলেটার একটাই দোষ ছিলো, সে অন্য পার্টির মতবাদে বিশ্বাস করে। তার শাস্তিস্বরূপ ছেলেটার উপর নানারকম শারীরিক অত্যাচার করা হয়। যারা শাস্তি দিচ্ছে, তাঁরাও ছাত্র। এবং সেখানে অনেক বহিরাগত ছাত্ররাও ছিলো। কলেজ কর্তৃপক্ষ খবর পেয়ে নানারকম চাপ সৃষ্টি করে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। আমি ছেলেটিকে কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই, আর দেখি ওর সারা গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা। সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা হয়। আমাদের সাথে মুচিপাড়ার বেশ কিছু ছাত্র ছিলো, মনে হয় বাইরের কিছু ছেলেও ছিলো। সকলেই নাকি পার্টির ছেলে। আমরা ওদের প্রশ্ন করি, এই মারদাঙ্গার রাজনীতি দিয়ে কোন ভালো কাজ সম্পন্ন হবে? ওদের কাছে আমার প্রশ্নের সদুত্তর ছিলো না। তবুও ওদেরই একজন আমাকে বলে, বেশি সেন্টু দেবেন না। আর আমাদের ভয় দেখিয়ে স্লোগান দিতে বলে, মাও সে তুং জিন্দাবাদ।
ছেলেটির উপর এই অত্যাচারের খবর তাড়াতাড়ি মুচিপাড়ার হস্টেলগুলোতে ছড়িয়ে যায়। দলে দলে ঐ পার্টির ছেলেরা, মানে কলেজের আর বহিরাগত, সব একসাথে জড়ো হয়। ঠিক হয় সাহেবপাড়ায় মাস একশনে যাওয়া হবে। তোমাদের বসাক স্যার আর পিএন চ্যাটার্জী স্যারকে ওদের সামনে রেখে হিউন্যান শীল্ড বানিয়ে একসাথে যেতে বাধ্য করা হয়, বলে সঙ্গে না গেলে ওনাদের মুন্ডু কেটে ওভালের মাঠে ফুটবল খেলা হবে।
সন্ধ্যাবেলা, তখন স্টাফেরা অনেকেই ক্লাবে তাস খেলছিল। কিছু ছেলে কলেজের সমস্ত টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়। শুধু প্রফেসর বড়ালের লাইনটা কাটতে ভুলে গিয়েছিলো। তারপর ওরা প্রফেসরদের বাড়িতে জবরদস্তি ঢুকে যায়। বাড়ি বাড়ি এসে ভয় দেখায়। অনেকের গাড়ি আক্রমণ করে। গাড়িতে আগুন ধরাতেও চেস্টা করেছিলো, কিন্তু পারে নি। ক্যাম্পাসে তখন দু’দলের পার্টির ছাত্রদের মধ্যেই নানান রকমের অস্ত্র ছিলো। এই সবই হচ্ছিলো ছাত্র আন্দোলনের নামে, এসব নাকি ওদের বিপ্লব ত্বরান্বিত করবে। ওরা সেই রাতে প্রফেসরদের সামনে পিস্তল ঠেকিয়ে সবাইকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করে, আর বলে মিছিল করে সাহেবপাড়া যেতে হবে। প্রফেসরদের খালি পায়ে আসতে হয়েছিলো, পায়ে জুতো পড়ারও সময় দেওয়া হয় নি। এসবের কারণ একটাই, ওদের পার্টির ছেলেকে সাহেবপাড়ায় জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, তাঁর বিরুদ্ধে মাস একশন নিতে হবে। কলেজের রেজিস্ট্রার মিস্টার ঘোষকেও বাড়ি থেকে ডেকে এনে বাধ্য করে মিছিলে সামিল হতে। ইতিমধ্যে ডক্টর বড়ালের বাড়ি থেকে ফোনে পুলিশে খবর দেওয়া হয়ে গেছিলো।
সেদিন অনেক নিরীহ ছাত্রদেরকেও ভয় দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়। উদ্দেশ্য একই, শিক্ষক ছাত্র সকলকে একসাথে জোর করে ভয় দেখিয়ে সাহেবপাড়া নিয়ে যাওয়া, আর নিজেদের পার্টির ছেলেদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসা। ইতিমধ্যে কলেজ মেন বিল্ডিং এর সামান্য দূরত্বে কয়েকটা বোমা পড়ে, উদ্দেশ্য সেই একই, ভয় দেখিয়ে কার্যোদ্ধার করা। টেলিফোনে গোলমালের খবর পেয়েই ইস্টার্ণ ফ্রনটিয়ার রাইফেলস আর পুলিশ চলে আসে, কিন্তু গেটের মুখেই বাধা পায়। কারণ ছেলেরা ফার্স্ট গেটের কলেজের সিকিউরিটির লোকজনকে ভয় দেখিয়ে পাশের গুমটি ঘরে বেঁধে রেখে গেটে তালা দিয়ে দিয়েছিলো। বন্ধ তালায় ঢুকতে না পেরে পুলিশ তখন হেভি ট্রাক দিয়ে ধাক্কা মেরে কলেজের গেট ভেঙ্গে কলেজে ঢোকে।
কলেজে ঢুকে পুলিশ পজিশন নিয়ে নেয়, মোটামুটি সবাইকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। আর মাইকে ঘোষনা করে ছাত্রদের হস্টেলে ফিরে যেতে বলে। বলে ওঁদের কাছে ফায়ারিং অর্ডার আছে, ওঁদের কথা না শুনলে গুলি চলবে। ইস্টার্ণ ফ্রনটিয়ার রাইফেলসের লোকজন বন্দুক হাতে পজিশনও নিয়ে নেয়। তখন প্রফেসর বসাক, প্রফেসর পিএন চ্যাটার্জি এঁরা হাত তুলে দৌড়ে গিয়ে পুলিশকে জানায় যে ওঁরা প্রফেসর, জোর করে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশের লোকজন তখন এগিয়ে এসে স্যারদের উদ্ধার করে। স্যারেরা পুলিশের পাহারায় রাত তিনটের সময় ঘরে ফিরে আসে। আর প্রচুর ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়, শোনা যায় প্রায় আশি জন। এঁদের মধ্যে পুলিশের এক উচ্চপদস্থ অফিসারের ছেলেও ছিলো। পরদিন সকালে আশেপাশের কোয়ার্টারের অন্য স্যারের পরিবারের লোকজন আমাদের এসে থ্যাংকস জানায়।
এই ঘটনার পরেই তখন আমি এডুকেশন ডিপার্ট্মেন্টকে (তখন DPI, Director of Public Instruction) ফোন করে ক্যাম্পাসের গন্ডগোলের কথা ফোন করে জানাই। প্রফেসর দীপ্তি দত্ত, আগে বিই কলেজেই পড়াতেন, তিনি তখন ADPI. উনাকে বলি, এভাবে একটা ক্যাম্পাসে পড়াশুনা হয় না। একটা চিঠিও দেওয়া হয়।
এরপরেই কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। সমস্ত হস্টেল খালি করে দেওয়া হয়। ক্যাম্পাসের স্যারেরা সবাই কলকাতা বা অন্যন্য জায়গায় নিজেদের বাড়িতে চলে যান। মনে আছে, তখন ক্যাম্পাসে আমরা মাত্র তিনটে পরিবার – আমরা, প্রফেসর বড়াল আর প্রফেসর পিএন চ্যাটার্জীরা। দুর্গা ব্যানার্জী ক্যাম্পাসের কোয়ার্টার ছেড়ে অস্থায়ীভাবে কলকাতার চোরবাগানের নিজের বাড়িতে চলে যান। কলেজের দ্বায়িত্ব দিয়ে যান প্রফেসর পিএন চ্যটার্জিকে। দুর্গা ব্যানার্জি মাঝে মাঝে আসতেন, কিছু কাজের মধ্যে উনার একটা বড় কাজ ছিলো চেক সাইন করা। আমার বাড়িতে এসে চেক সাইন করতেন।
আসলে জীবনের অনেকগুলি সেরা দিন তো আমার বিই কলেজের আশ্রমিক ক্যাম্পাসেই কেটেছে। বিই কলেজের সেরা সময়ে আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম। তেমনি ক্যাম্পাসের কালো দিনগুলোর কথাও মাঝে সাঝে মনে পড়ে। অনেক দুঃখ নিয়েই কলেজের খারাপ দিনের কথাগুলো লিখলাম। সব মনে করতে চাইলেও স্মৃতি এখন আর তেমন জোড়ালো নয়, তবু যেটুকু মনে আছে লিখলাম।
আগেই বলেছি, আমার এখন ৯২ বছর বয়স, আমার আন্দাজে পাঠকদের সকলেই আমার থেকে বয়সে ছোট। তোমাদের সকলের জন্য আমার অনেক শুভকামনা রইলো।
অলকা বসাক
এপ্রিল, ২০২২
একটা প্রশ্ন প্রায়ই মনে আসে, আচ্ছা, মুচিপাড়া নামটা নিশ্চয়ই তোমাদেরই দেওয়া? এরকম নাম তোমরা কেন দিলে? প্রথম প্রথম আমি মুচিপাড়া বুঝতামই না, সেটা কোথায়? এই উদভট নামটাই বা কি করে এলো?
darun laglo….khub valo hoyeche lekha ta