ধীমান চক্রবর্তী, ১৯৯৮-সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং
মেজকার সাইকেলের দুই হ্যান্ডেল থেকে ঝুলছে দুটো ব্যাগ। একটা চটের.. তার মধ্যে আনাজপাতি ভর্তি। পালং শাকের ডগার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে খবরের কাগজে মোড়া একটা বেশ বড়োমতোন কিছু। জিনিসটা চৌকো। কোনো বই নাকি! বই কি অতো বড়ো হয়? অন্য ব্যাগটা মার্কিন কাপড় কেটে বানানো.. মাপে ছোটো। ওটা মাছের ব্যাগ। রোজ কাচা হয়। দিদাইয়ের হুকুম। দুটো ব্যাগ সাইকেল থেকে নামানো হলেই দিদাই আসবে গঙ্গাজলের ঘটি নিয়ে.. মেজকার ভাষায় ‘হাতলশুদ্ধি’ করার জন্য।
মেজকা এরম অনেক মজার মজার কথা বলে। অনেকে আবার রেগেটেগেও যায়, কিন্তু মেজকার কিস্যু যায় আসে না। মুখে একটা আজব হাসি সবসময়। আর মাঝে মধ্যেই মনের মতো কোনো জিনিস দেখলে বা শুনতে পেলেই সুর করে অদ্ভুত সুন্দর একটা কথা বলে। সেটার মানে আমি জানি না। তবুও মেজকার গলায় বেশ ভাল্লাগে শব্দটা শুনতে..
“অবাংমনসগোচরম্!”
মেজকার মুখে যুদ্ধ জিতে ফেরার মতো একটা হাসি! যেন এইমাত্র কদমতলা বাজারে ‘তাড়কা রাক্ষুসি’ কিম্বা ‘বকাসুর’ বধ করে এলো! আমার নজর কিন্তু ওই খবরের কাগজে মোড়া জিনিসটায়। কী থাকতে পারে ওর মধ্যে! আনাজসমেত ব্যাগ রান্নাঘরের দিকে চলে যাবার সময় মেজকা টুক করে খবরের কাগজের মোড়কটা তুলে নিলো। আমি মেজকার দিকে ঘাড় নেড়ে জানতে চাইলাম কী ওটা। মেজকা কোনো কথা না বলে হাসি হাসি মুখ করে মাথা নাড়তে নাড়তে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বললো।
মেজকার এই এক বড্ড বাজে স্বভাব.. মাঝে মাঝেই হাত পা নেড়ে বোঝানো! কিছুতেই কথা বলানো যায় না! আমি হাল ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে শুনতে পেলাম মেজকা কায়দাকে বলছে.. “এটাকে এইভাবেই কাগজ মোড়া অবস্থায় সাবধানে রেখে দিস। কেউ যেন নাগাল না পায়। আমার গুরুদেবের লেখা বই.. দুনিয়ায় এমনটা আর নেই! দু মলাটের মধ্যে এক আশ্চর্য জগৎ! খুব সামলে রাখিস ভাই!”
নারকোল কুরো দিয়ে মুড়ি খেতে খেতে ভাবছি.. কী এমন বই যাকে মেজকা তার প্রিয় তিনটে বইয়ের চেয়েও বেশি যত্ন করে! যত্ন তো নয়.. একেবারে ঠাকুরদেবতার মতো ভক্তি করে! ‘গুরুদেব’ এর লেখা বই বলে কথা!
আমি কায়দার কাছে শুনেছি রবীন্দ্রনাথকে তার কাছের লোকেরা ‘গুরুদেব’ বলে ডাকতো। এখন সবাই নামের আগে ওই ‘কবিগুরু’ নয়তো ‘বিশ্বকবি’.. এদুটোর একটা গুঁজে দেয়।
রবীন্দ্রনাথের পদবী ঠাকুর.. আমার যেমন চক্রবর্তী.. মামার যেমন ব্যানার্জি। কিন্তু বড়োরা সবাই রবীন্দ্রনাথকে যেন সত্যিসত্যিই শিবঠাকুর বা কালীঠাকুরের মতো পুজো করে! আমার তো অবাক লাগে! এ কী রে বাবা! পদবীটাই তো ঠাকুর! লোকটা তো মানুষই ছিলো! জন্মের তারিখ হলো পঁচিশে বৈশাখ আর মরে গিয়েছিলো বাইশে শ্রাবণ। লেখাগুলো পড়তে বেশ লাগে! সবচাইতে বেশি ভালো লাগে ওর বানানো গানগুলো! নন্টেদা সরকারি চাকরি পাওয়ার পরে ফিলিপস্ এর একটা বিরাট ক্যাসেট প্লেয়ার কিনেছে। তাতে জর্জ বলে এক সাহেবের গাওয়া অনেকগুলো গান আছে। আমি তো শুনে শুনেই প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশটা গান শিখে গেছি। সাহেবরা অনেকদিন এদেশে ছিলো বলেই ওই জর্জ সায়েব না হয় বাংলা গান শিখতে পেরেছে। কিন্তু যার বানানো গান সেই লোকটার পদবী ছিলো ঠাকুর, লোকটা তো আসলে ঠাকুর ছিলো না।
যদিও মেজকা মাঝে মাঝে বলে সোমবার থেকে শুক্কুরবার অবধি কাজের দিন। তার পরের দুটো দিন নাকি বাঙালিরা দুই ঠাকুরের পুজো করে। শনিবারে শনিঠাকুর.. আর রবিবার রবিঠাকুরের পুজো হয়। আমার বেশ মজাই লাগে এটা শুনতে।
কিন্তু আমি দেখেছি ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামটা শুনলেই বড়োরা এমন একটা ভাব করে যেন সে ভগবান বা ওইরকম কিছু একটা হবে। আরে.. রবিঠাকুরের কি হিসি কিম্বা পায়খানা পেতো না.. নাকি ওই দাড়িও কাটার দরকার হতো না! নিশ্চয়ই দাড়ি কাটাতে হতো। না কাটলে ওই দাড়ি বাড়তে বাড়তে তো রবীন্দ্রনাথের পা পর্যন্ত নেমে আসতো.. তারপরে নিজের দাড়িতেই পা জড়িয়ে ‘ধপাস্!’ ভেবেই আমার বেজায় হাসি পেয়ে গেলো.. সবার ‘গুরুদেব’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের দাড়িতে পা জড়িয়ে পড়ে গিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে!
আবার গজাদা আর নন্টেদা লম্বা ঝুলপিওলা হিন্দি সিনেমার একটা ঢ্যাঙামতো লোককে ‘গুরুদেব বচ্চন’ বলে ডাকে!
দিদাইয়েরও একটা ‘গুরুদেব’ আছে। সে মাঝে মাঝে হলদে পোস্টকার্ডে আশীর্বাদ পাঠায়.. আর দিদাই তার ঠিকানায় টাকা পাঠায়। মামা কদমতলা বাজারে ব্যাঁটরা থানার পাশের পোস্ট অফিস থেকে ‘মানিঅর্ডার’ না কী যেন একটা করে টাকা পাঠিয়ে দেয় সেই ‘গুরুদেব’ লোকটাকে।
আবার এদিকে মেজকারও বই লেখা ‘গুরুদেব’ এসে হাজির! বাপরে.. চারদিকে তো শুধু গিজগিজ করছে ‘গুরুদেব!’
যাকগে.. ওসব ভেবে লাভ নেই। বরং অঙ্কগুলো তাড়াতাড়ি কষে কুমোরপাড়ার গরুরগাড়ি নিয়ে রচনাটা লিখে ফেলি! বাবা বলে গেছে সবচেয়ে ভালো লাগা পদ্যটাকে রচনার মতো করে লেখা প্র্যাক্টিস করতে!
*******
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়!
কিছুক্ষণ মাথার ভেতরে স্মৃতিবিস্মৃতির যুদ্ধ চলতে থাকে!
অবধারিত পঞ্চাশের দিকে এগিয়ে চলা হিসেব কষা মন প্রাণপণে চায় স্মৃতিগুলো যেন জিতে যায়!
সে নিজের মনে বলে ওঠে..
“তোকে আজকে হয়তো রাত জাগতে হবে।”
সে সেই ভোরের দিকে তাকিয়ে আছে একা..
একলব্যের মতো..
সেই পবিত্রতম ভোরের সাক্ষী থাকবে বলে..
প্রতি চব্বিশে বৈশাখ রাতেই পিছনে ফিরে তাকাই! ফ্ল্যাশব্যাকে ছোটোবেলার আমির সাথে একটুকরো হাসিবিনিময়!..
মনে অকালে নামে শেষবর্ষণের বৃষ্টি!
এই একটা দিনের জন্য হয়তো বহুদিন আগে গানের মাস্টামশাইএর সেই আশীর্বাদ টা সত্যি হয়ে ওঠে..
“সুরে বাঁচো!”
“রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা, মন যে কেমন করে হলো দিশাহারা। যে গিয়েছে ডেকে.. রজনীতে সেকি দ্বারে দিলো নাড়া, মন যে কেমন করে হলো দিশাহারা।”
সারাদিন ধরে ঝরে সুর.. শব্দেরা সুরে সুরে নিজেদের ভিজিয়ে নিয়ে অবয়ব পায় সবুজ মাটিতে.. যে মাটি গভীর যত্নে সঞ্চয় করে রেখেছে দুটো বাইশের জল।
এক বাইশে শ্রাবণ!
আর দুই হলো বাইশে আগস্ট, সেই জর্জ সাহেবের জন্মদিন!
জেগে ওঠে গান..
সেই বুড়ো গাছের তলায় একা বসে বসে ভিজতে চায় সুরের ধারায়।
বুড়ো সেই চির সবুজ মহীরুহ জর্জরিত হয়েও নিরন্তর টুপ্.. টুপ্.. করে বাঁচার রসদ জোগান দেয়।
তারই ছায়ায় বেড়ে ওঠা.. তারই সুরে সুরে সুর মেলাতে চেয়ে সাঁঝবেলাতেই বেলা কাটিয়ে দেয়া.. এ যেন তার নিত্যদিনের পুজো।
সেখানে মূর্তি নেই..
নেই পুজোর কোনো আয়োজন। কেউ ফুল এনে সাজিয়ে রাখে না পূজার বেদী। তিনি স্বয়ং চকিত হাসির দহনে দেন সেই গহন অন্ধকার ভেদ করে।
কখনো খেলার ছলে পুজোর মতো আয়োজন করে অনেক প্রসাদের সমাহার থেকে সে নিজে ছুটে আসে পালিয়ে।
তার নেই কোনো পুজোর আয়োজন, নেই প্রসাদের প্রয়োজন।
কখনো সুর ভুলে সে ঘুরে বেড়ায় কচি ধানের সবুজ খেতে। একটু এগোলেই দেখতে পায় ফুটে আছে আলোর অমল কমলখানি।
সে ভাবে.. কে ফোটালে এমন আলোয় আলোকময় করা ফুল!
ঘাসে ঘাসে পা ফেলে যায় বনের পথে যেতে। ফুলের গন্ধে তার চমক লাগে। মেতে ওঠে মন। জগতের কাছে হয়তো তার নেই কোনো পাওয়া না পাওয়ার হিসেব।
সব হিসেব চুকিয়ে.. সব অঞ্জলির ফুল শুকিয়ে সে চলে যায় সেই পথে..
যেখানে চলে যেতে যেতে কোনখানে তাঁর পরশ আসে.. কখন কে জানে।
কী সে অচেনা ফুলের গন্ধ তার মনে নিয়ে আসে এক গোপন গভীর আনন্দ, সে জানে না।
সে জানেই না কোন পথিকের কোন গানে কখন তাঁর পরশ আসে।
তবু সে কোনো অজানা বনপথে চলে যেতে পারে যদি কোনো বাঁশির ঘুমভাঙানিয়া.. দুখজাগানিয়া ডাক তার কানে আসে।
তাই তো সে কান পেতে থাকে। কোনো গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শোনার জন্য।
রাতের পাখি একা একা গান গেয়ে যায় সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে।
*********
এই সব গান দৃশ্য হয়ে উঠতো.. আজও ওঠে সেই বাঙাল সাহেবের মন্দ্র-গভীর কন্ঠে!
যেখানে একমাত্র সঙ্গী হিসেবে দুবাহু বাড়িয়ে কেবল আছে যে.. তাকে বার বার অস্বীকার করতে চেয়েও শেষে তারই কাছে ফিরে এসে তারই গান গাওয়া !
সে আর কেউ নয়.. নানান সুরে ভিজিয়ে দেওয়া আস্ত একটা রবীন্দ্রনাথ !
(‘একলা পথে’ নামে আমারই একটা পুরোনো এবং যথারীতি অসম্পূর্ণ ধারাবাহিক থেকে)
Add comment