গণেশ ঢোল, ১৯৮৭ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
খুব ছোটবেলায় দেওয়ালের ক্যালেন্ডারে এক পাকাচুল, পাকা দাড়িওয়ালা লোকের ছবি দেখে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ওটা কার ছবি?” মা বলেছিলেন, “রবি ঠাকুরের।” তখন ভাবতাম রবি ঠাকুরও বুঝি হরনাথ ঠাকুর, অনুকূল ঠাকুরের মতো কোনো গুরুদেব। আর একটু বড় হয়ে যখন সহজ পাঠের লেখাগুলো মনে দোলা দিয়ে যেতে লাগল তখন মনে হত রবীন্দ্রনাথ বুঝি রাম মাস্টারের মতো কোনো বাচ্চাদের স্কুলের টীচার। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়তাম – ‘ঘন মেঘ বলে ঋ / দিন বড় বিশ্রি‘ ; কিংবা ‘ডাক পাড়ে ও ঔ / ভাত আনো বড় বৌ।‘
আরও পরে যখন পড়ছি,
‘এসেছে শরৎ, হিমের পরশ
লেগেছে হাওয়ার পরে …‘
তখন সত্যি সত্যি কেমন শীত করে উঠত। কিংবা ওই কবিতারই এই লাইনগুলো,
‘আমলকি বন কাঁপে যেন তার
বুক করে দুরুদুরু
পেয়েছে খবর পাতা খসানোর
সময় হয়েছে শুরু …‘
পড়লে সত্যি সত্যি আমার বুকটাও কেঁপে উঠত।
সেবার আমাদের স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশন। গরিব স্কুল প্রত্যেক বছর ফাংশন করার সামর্থ্য নেই। আমরা তখন স্কুলের সবচেয়ে উঁচু ক্লাসে মানে ক্লাস ফোরে পড়ি। তাই আমাদের দায়িত্ব ও আনন্দ অনেকটাই বেশি। রাম মাস্টারমশাই আমায় ডেকে বললেন, ” তোকে ‘দুই বিঘা জমি‘ কবিতাটা আবৃত্তি করতে হবে। দু‘দিনের মধ্যে সঞ্চয়িতা থেকে পুরো কবিতাটা মুখস্থ করে আনবি। আমি ঘরে এসে কবিতাটা বার করে লাইন গুণতে শুরু করি। কবিতার দৈর্ঘ্য দেখে তো আমার সেই ‘বুক করে দুরুদুরু‘। স্যার বলে দিয়েছেন, ” যদি সম্পূর্ণ কবিতা মুখস্থ করতে পারি তবে সারা বছর ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে পারব। বারবার পড়তে থাকি, নিজের খাতায় লিখে নিই সে কবিতা। ওই লিখতে-লিখতে আর পড়তে-পড়তে খুব সহজেই মুখস্থ হয়ে যায় আমার। এখনও যখন বহুদিন পর সুরাট থেকে নিজের বাড়ি খড়গপুরে ফিরি তখন খরিদা লেভেল ক্রসিং-এর কাছে পৌঁছলেই মনে মনে আওড়াতে থাকি, ‘নমো নমো নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি / গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।‘ যদিও খড়্গপুরে গঙ্গা কেন কোনো নদীই নেই। বাঙালি, উড়িয়া, তেলুগু, মারোয়াড়ি, পাঞ্জাবির পাঁচমিশেলি শহর। তবু বাড়ির কথা, ছোটবেলার কথা ভেবে মন খারাপ হলে, কবিতার ওই অংশটিই বারবার মনে পড়ে।
যাইহোক পরদিন স্কুলে গিয়ে প্রথমেই বলি, “স্যার মুখস্থ হয়ে গেছে।”
– “ঠিক তো? ধরব কিন্তু ভুল হলে আঙুলের গাঁটে ডাস্টার দিয়ে মারব।”
ওই কথার কোনো জবাব দিই না, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বলে উঠি, “স্যার কুলটা মানে কী?”
– “কোথায় পেলি ঐ শব্দ?”
– “এই যে এখানে লেখা – ‘ধিক্ ধিক্ ওরে, শতধিক্ তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি।”‘
মাস্টারমশাই অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকেন ওই লাইনটার দিকে, তারপর বলেন, “কুলটা মানে খারাপ মেয়ে। থাক্, তোকে ওই অংশটা আর আবৃত্তি করতে হবে না।” এই বলে উনি ‘ধিক্ ধিক্ ওরে, শতধিক তোরে নিলাজ কুলটা ভূমি।‘ থেকে ‘যত হাস আজ, যত কর সাজ, ছিলে দেবী হলে দাসী‘ পর্যন্ত অংশটুকু বাদ দিয়ে দেন। কিন্তু দিলে কী হবে, আমার তো ততক্ষণে মুখস্থ হয়ে গেছে। যতবার ঐ অংশটা বাদ দিয়ে বলতে যাই, ততবার ঠিক ব্রাত্য শব্দগুলো চলে আসে ঠোঁটের ডগায়। শেষে মাস্টারমশাই হাল ছেড়ে দিলেন। মাঝে মাঝে মুখস্থ করার থেকেও ভুলে যাওয়াটা কঠিন হয়ে ওঠে। আর সবচেয়ে মজার কথা, আজ সম্পূর্ণ কবিতার মধ্যে ঐ লাইনগুলোই দাঁড়ি, কমা সমেত আমার স্মৃতিতে অটুট রয়ে গেছে।
আমার রবীন্দ্রনাথ কিন্তু অযুত আলোকবর্ষ দূরের কোনো জ্যোতিষ্ক নয়, বরং খুব কাছের। রবীন্দ্রনাথের গান, গল্প, কবিতা, ছবি, উপন্যাস – সবই শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো স্বাভাবিকভাবে এসেছে জীবনে, একেক বয়সে একেক রকম ব্যাঞ্জনা নিয়ে। হয়তো সেভাবে রবীন্দ্রনাথ পড়িনি। তবু যা পড়েছি তাও কিছু কম নয়। তাছাড়া আমাকে যে সবকিছু পড়তেই হবে এরকম মাথার দিব্যিও তো কেউ দেয়নি। যেমন সবার বাড়িতেই ডিক্সনারি, এনসাইক্লোপিডিয়া রাখা থাকে; কিন্তু কেউই সেসব বইয়ের প্রতিটি পাতার প্রতিটি শব্দ পড়ে দেখে না। নিজের প্রয়োজনমতো খুঁজে নেয় শব্দার্থ বা জ্ঞাতব্য বিষয়। তেমনি আমিও রাগে, দুঃখে, ক্রোধে, অভিমানে, ভালোবাসা-ভালোলাগায় আশ্রয় পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়।
আমি তখন ছিলাম আসামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে, নাগাল্যান্ড বর্ডারের কাছে। সেখানে ওএনজিসির অয়েল ফিল্ড। মাটির গভীর থেকে উঠে আসে তেল। সারা দিনরাত চলে দানবের মতো সব অতিকায় পাম্প। আসামে যেহেতু টেররিস্ট অ্যাক্টিভিটি বেশি, তাই আমাদের নিরাপত্তার জন্য আছে সিআইএসফের লোকজন। সেদিন কাজের খুব ধকল গেছে। সন্ধেবেলা চান-টান করে একা একাই পায়চারি করছি। হঠাৎ শুনি রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে, “আকাশ জুড়ে শুনিনু ঐ বাজে ঐ বাজে।‘ কাছে গিয়ে দেখি সিআইএসেফের কুক একটা খাকি হাফ প্যান্ট আর হাতাওয়ালা গোলগলার সাদা গেঞ্জি (যেগুলোকে কলেজে আমরা পাঁচু গেঞ্জি বলতাম) পরে তন্ময় হয়ে গান শুনছে। কাছে গিয়ে বলি, “আপনি বাঙালি?”
-“হ্যাঁ স্যার।”
-“কী শুনছিলেন?”
খুব লজ্জা পেয়ে সে বলল, “আসলে আজ পঁচিশে বৈশাখ তো, তাই বাংলাদেশ রেডিও খুলে একটু গান শুনছিলাম। মেয়েটার কথা খুব মনে পড়ছিল, আমার মেয়েও খুব ভালো গান গায়।”
নিজেকেই মনে মনে ধিক্কার দিলাম। কাজের চাপে আমার মনেই নেই যে আজ পঁচিশে বৈশাখ। কিন্তু এই লোকটি যার পড়াশোনা সেরকম নয়, বছরের বেশির ভাগ সময় যার খাকি হাফ প্যান্ট আর পাঁচু গেঞ্জি পরে কেটে যায়, সে ঠিক মনে রেখেছে রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর জন্মদিনকে।
আমি জিজ্ঞেস করি, “আপনার নাম কী, কতদূর পড়াশোনা করেছেন?”
লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে, “স্যার আমার নাম রবীন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। পড়েছি ক্লাস টেন পর্যন্ত।”
আমি বলি, “বাঃ আপনার নাম রবীন্দ্রনাথ! মেয়ের নাম কী?”
– “মেয়ের নাম গীতাঞ্জলি। পঁচিশে বৈশাখ জন্মেছিল তো তাই নাম দিয়েছিলাম গীতাঞ্জলি।”
আমি আরও অবাক হয়ে বলি, “আপনার নাম রবীন্দ্রনাথ, আপনার মেয়ের নাম গীতাঞ্জলি, দেশঘরে আপনার বাড়ির নাম আবার শান্তিনিকেতন নয় তো?”
সে লজ্জায় মাটিতে মিশে গিয়ে বলে, “হ্যাঁ স্যার।”
‘দ্য সানডে ইন্ডিয়ান’ পত্রিকায় ইতিপূর্বে প্রকাশিত।
Add comment