রমা সিনহা বড়াল, ১৯৭৬ আর্কিটেকচার ও প্ল্যানিং
তখন পড়ি ক্লাস এইট এ। পরেরদিন পঁচিশে বৈশাখ, আমাদের রবিঠাকুরের জন্মদিন। আমরা ক্লাস ফোর, সিক্স, আর এইটে পড়া তিন বোন খুব উত্তেজিত, কারণ আগামীকাল দিদি আমাদেরকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নিয়ে যাবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে, ও সেই সাথে ঠাকুরবাড়ি দেখাতে। ছোটবেলা থেকেই রবিঠাকুর বড়ই আপন মনে হতো। সেই সহজপাঠের “জল পড়ে, পাতা নড়ে”, বা “আজ জঙ্গল সাফ করার দিন” লেখার সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয়। “শিশু” কবিতায়, শিশু বয়সে, তাঁর লেখার মধ্যে যেন নিজেদেরই খুঁজে পাই।
যাই হোক, পরদিন ভোর পাঁচটার সময় উঠে তৈরি হয়ে রওনা হলাম জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। গণেশ টকীর মোড়ে বাস থেকে নেমে রবীন্দ্র সরণী ডান দিকে ট্রামলাইন ধরে খানিক এগোতেই আমাদের স্বপ্নের ঠাকুরবাড়ি। দলে দলে মানুষজন অনুষ্ঠান শুনতে যাচ্ছে। মাইকে ভেসে আসছে সুরেলা রবীন্দ্রসঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি, শ্রুতিনাটকের আওয়াজ।
রবিঠাকুরের বসতবাড়ি এখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাস। এই বাড়ির কিছু অংশ তাঁর জন্মস্থান হিসাবে সংরক্ষিত। বাকি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস, আর নাচ, গান, অভিনয়ের ক্লাস হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সেই আম্রপালী আমের গাছ, ঢাকা দেওয়া ঝুল বারান্দায কাঠের রেলিং – ছোট রবির কাঠের রেলিং এ ছিপটি মেরে ঘোড়া ঘোড়া খেলার সঙ্গী, যার বর্ণনা “আমার শৈশব” বইতে পেয়েছি, চোখের সামনেই সেসব দেখতে দেখতে নিজের শৈশবকেও অনুভব করতে পারলাম। মূল সংরক্ষিত বাড়ির দোতলায় যেখানে বালক রবির জন্ম ও ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে ওঠা, সেই সুন্দর করে আল্পনা দেওয়া, ফুল দিয়ে সাজানো ঘরে প্রবেশ করে, মনে হলো যেন এক মন্দিরে এলাম। অনুভব করলাম এক অদ্ভুত প্রশান্তি। হাতে করে নিয়ে আসা ফুলের স্তবক রেখে প্রণাম জানালাম। রবিঠাকুরের ও তাঁর পরিবারের ব্যবহৃত জিনিষপত্র সুন্দর করে সংরক্ষিত করা আছে। বাড়ির সামনে মঞ্চ থেকে শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্রের উদাত্ত কণ্ঠে ভেসে আসছে “হে নূতন দেখা দিক আবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ”।
সেই ছোট বয়স থেকে আমাদের রবিঠাকুরের সঙ্গে পরিচয়। আমরা যারা বি ই কলেজ ক্যাম্পাসে ছোট থেকে বড়ো হয়েছি, রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনটা খুব সুন্দর করে কাটাতাম।
একবার আমরা আমাদের বাড়িতে পঁচিশে বৈশাখ পালন করবো ঠিক করলাম। বি ই কলেজের ছাত্রীদের সাথে আমাদের একটা খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। ওরা সকলেই প্রায়দিন বিকালে কলেজে ক্লাসের পর আমাদের বাড়ি আসতো। আমাদের বড়ো দিদির মতো ছিল। ওদের সাথে খেলা, গল্প , গান ,বাজনা সব কিছু খুব আনন্দের সাথে আমরা করতাম। ভারতীদি, কোয়েলাদি (আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট -এ পড়তো,) আমাদের বন্ধুর মতো, আবার বড়ো দিদির মতো, ছিল। পঁচিশে বৈশাখ পালন করার প্রস্তাবে ভারতীদি আমাদের “মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি…” গানের সাথে নাচ শিখিয়েছিল। কোয়েলাদি আর মণিদীপাদি (ইলেকট্রনিক্স ডিপার্টমেন্ট) গানটা গেয়েছিল। রবিঠাকুরের লেখা ছোটদের নাটক “পেটে খেলে পিঠে সয়” শেখানোর দায়িত্বে ছিলেন মায়া কাকিমা (প্রফেসর ভূপাল দত্তের স্ত্রী) ও ভারতীদি। অনুষ্ঠানের রিহার্সাল আমাদের বাড়িতেই হতো। প্রফেসর রত্নেশ্বর বোসের ছেলে রঞ্জিত কিছুতেই “পেটে খেলে পিঠে সয়” বলতে পারতো না। বলতো “পিঠে খেলে পিসে হয়.” সবাই খুব মজা পেতো। অনুষ্ঠানের দিন আমাদের বড়ো ঘরে মাদুর, শতরঞ্চি পেতে দর্শকদের বসার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। আমার দাদা, বাবু (প্রফেসর ভূপাল দত্তের ছেলে), বিছানার চাদর, দড়ি দিয়ে স্ক্রিন বা পর্দা তৈরী করেছিল। অপটু হাতে আঁকা রবিঠাকুরের ছবিতে মালা দিয়ে অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। মা সকলের জন্য লুচি, আলুর তরকারি ও বোঁদে দিয়ে সবার জন্য জলখাবারের ব্যবস্হা করেছিলেন। কোন আড়ম্বর ছিল না, কিন্ত মনের অনাবিল আনন্দ ছিল। জলখাবার তৈরিতে শ্যামলীদি, অলকা মাসিমা, আমার দিদি, হস্টেলের দিদিরা মাকে অনেক সাহায্য করেছিল।
এর পরেরবার মায়া কাকিমার বাড়ি অনুষ্ঠান করা হয়। হেলেন (প্রফেসর পি এন চ্যাটার্জির মেয়ে), জোনাকি (আমার ছোটবোন), বাবু, তিলক, অলক (প্রফেসর ভূপাল দত্তর ছেলে), কলি, মিলি, রাণা (ডঃ শীলের ছেলেমেয়েরা), বাবুয়া (প্রফেসর যাদবলাল চক্রবর্তীর ছেলে), মৌ, মুন্নি (ডঃ শঙ্কর সেনের দুই মেয়ে) এরা সবাই অংশগ্রহণ করতো।
পরের দিকে ধীরে ধীরে স্টাফ ক্লাবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রফেসর যাদবলাল চক্রবর্তী, প্রফেসর ভঞ্জ, প্রফেসর প্রদীপ রায়, গোবিন্দ বাবু এনারা নাটক করা, পরিচালনা করা ইত্যাদি করতেন। গান, নাচ, নাটক মায়াকাকিমা, শ্যামলীকাকিমা (প্রফেসর অবনি দে’র স্ত্রী) করাতেন। এসব দিনগুলো স্মৃতি ভোলার নয়।
শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে পরিণতবয়স্ক – জীবনের প্রতিটি স্তরে তাঁর লেখা পড়লেই মনে হয় এতো আমার মনের কথা! কৈশোরের শুরুতে যেমন আমাদের অনুসন্ধিৎসা খুব বেশি হয়। তাই সে বয়সের উপযোগী লেখা “শিক্ষার বাহন”, “গোরা” ও আরো অনেক ছোট গল্পের সাথে নিজেদেরকে একাত্ম করা যায়। রবীন্দ্র গীতিনাট্য / নৃত্যনাট্য “বাল্মিকী প্রতিভা”, “তাসের দেশ”, “কালমৃগয়া” মনকে নাড়া দেয়। এই প্রসঙ্গে বলি এই নৃত্য নাট্যগুলি আমাদেরকে রবিঠাকুরকে আরোও কাছে নিয়ে এসেছে।
“কালমৃগয়া” বললেই ছোটবেলায় নূপুরের (প্রফেসর দুর্গাদাস ব্যানার্জীর মেয়ে) আশ্রম বালিকার ভূমিকায় নৃত্য, “তাসের দেশে” হরতনির ভূমিকায় আমার নাচ, হেলেন (প্রফেসর পি এন চ্যাটার্জির মেয়ে) ,জোনাকির যথাক্রমে রাজপুত্র ও সদাগর পুত্রের নৃত্যাভিনয়, চন্ডালিকা-তে নূপুরের ‘প্রকৃতি’, ডাকঘর নাটকে আমার দইওয়ালা, চুড়িওয়ালার ভূমিকায় নৃত্যাভিনয়ের কথাগুলো মনে পড়ে যায়। এগুলির মধ্যে দিয়ে আমরা তখন আমাদের কৈশোরের রবীন্দ্রনাথকে চিনেছিলাম।
যৌবনের আকুতি, উন্মাদনা আমাদের জানিয়েছিল শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, মায়ারখেলা, শাপমোচনের মতো নৃত্যনাট্য। প্রেম, ভালবাসার আনন্দ, বিচ্ছেদের বেদনা, তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে এতো সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। গান বা কবিতার কথাগুলি যেন আমাদেরই মনের ভিতরের কথা।
পরিণত বয়সে “সীমার মাঝে অসীম তুমি…..”, বা “বিশ্ববীণা রবে বিশ্বজন মোহিছে….” ইত্যাদি গানের মধ্যে দিয়ে জীবনকে অনুভব করা যায়। জীবনের শেষপ্রান্তে বন্ধুর প্রয়োজন প্রকাশ হয় “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছো দাঁড়ায়ে….” এর মধ্যে দিয়ে।
প্রকৃতির নানান বর্ণের রূপ তাঁকে মুগ্ধ করতো। ছয়টি ঋতুকে তিনি বর্ণনা করে সৃষ্টি ঋতুরঙ্গ। প্রতিটি লেখাই আলাদা করে প্রতি ঋতুকে চিনিয়ে দেয়। গ্রীষ্মের বর্ণনা “দারুণ অগ্নিবাণে….”, বর্ষার “আজ বারি ঝরে ঝরঝর…”, হেমন্তের “হেমন্তে ঐ বসন্তের….” বা শীতের “হিমের রাতে ঐ গগনের…”, বসন্তকালে “ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে…..”, গানের কথাই চিনিয়ে দেয় সেই সকল ঋতুকে।
এই মহান ব্যক্তিত্বের জীবন সম্বন্ধে ধ্যান ধারণার কোন পরিমাপ নেই। তাঁর প্রতিটি লেখার মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় যে তিনি জীবনের শেষ বিন্দু অবধি তার রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধকে অনুভব করতে ভালবাসতেন। জীবনের সাথে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য বন্ধন তিনি প্রাণভরে উপভোগ করতেন। তাই সৃষ্টি করেছিলেন “শান্তিনিকেতন” এর।
তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গায়ক, লেখক, ঔপন্যাসিক, চিত্রশিল্পী, বৈজ্ঞানিক, দেশপ্রেমিক এবং মনস্ত্বাত্তিক। বর্তমান চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর গান রোগীর ব্যাথা, যন্ত্রণা উপশমের কাজে ব্যবহৃত হয়। আমি নিজে তার সুফল পেয়েছি। মন খারাপ হলে ভালো ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত মনকে ভালো করে দেয়। গানের কথা, সুর কানের মধ্যে দিয়ে মর্মে প্রবেশ করে।
“রবির কিরণে” আলোকিত আমরা নিজেদেরকে বিকশিত করতে পেরেছি, জীবনবোধে সমৃদ্ধ করতে পেরেছি সেই “শিশুকাল” থেকেই তাঁর “সহজপাঠের” মধ্যে দিয়েই। পঁচিশে বৈশাখ তাই তাঁর ভাষাতেই বলি, “আজি হতে শতবর্ষ পরে….” আমরা আজও তাঁর কবিতা দিয়েই তাঁকে জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করি।
অন্তরের প্রণাম জানাই এই মহাকবিকে।
Add comment