স্নিগ্ধা বিশ্বাস (বাসু), ১৯৬৮ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং
ছোটবেলার স্কুলের দিন থেকেই নিজের মতন করে কতই না লিখতে হয়েছে। বাংলা রচনা, বা ইংলিশ essay, তারপর কলেজে, হায়ার স্টাডিজের সময় ল্যাব বা প্রজেক্ট রিপোর্ট, এইসব নিজের মতন করে নিজের ভাষায় লিখেছি। কিন্তু আজ এই বয়সে কেউ যদি আমাকে নিজেকেই নিজের বিষয়ে রচনা লিখতে বলে, তাহলে যা অবস্থা হয়!!!!
আমি অসাধারণ নই, অতি সাধারণ, তাই নিজের ব্যান্ড বাজানোর প্রশ্নই ওঠে না। তবুও ভাবলাম একটি সাধারণ মেয়ের সাধারণ জীবনের কিছু কথা একটু লেখার চেস্টা করাই যাক। কাজটা অত সহজ নয়, কারণ গত ষাট সত্তর বছরের কোনটা লিখবো? আর কোনটাই বা বাদ দেবো? যা যা হটাৎ হঠাৎ মনে আসছে, কিছু লিখে রাখলাম।
আমি মোটামুটি সাধারণ ঘরের মেয়ে। রক্ষণশীল পরিবারে আমার জন্ম। আমার দাদু, পেশায় জজ, কিন্তু বড়ই কনজারভেটিভ। আর সেই তুলনায় আমার ঠাকুর’মা ছিলেন প্রগ্রেসিভ, মানে আমি চল্লিশ পঞ্চাশের দশকের কথা বলছি। সেই সময়ের মহিলাদের প্রগ্রেসিভ হওয়া এত সহজ ছিলো না। আমাদের ছিলো জয়েন্ট ফ্যামিলি। বাবা কাকারা সকলে একসঙ্গে থাকতাম। সেখানে আমার ঠাকুর’মা নিজের বক্তব্য যুক্তি দিয়ে বেশ জোরের সাথেই রাখতেন।
দাদু দক্ষিণ কোলকাতার অভিজাত পাড়ায় বাড়ি করেছিলেন। মনে আছে, আমাদের বাড়িতে খুব সুন্দর একটা বাগান, অনেকগুলো ছাত আর বড় বড় দালান ও বারান্দা ছিলো, এখনও আছে। আমাদের, মানে ছোটোদের বাইরে যাবার অনুমতি ছিলো না, তাই বন্ধুদের বাড়িতে ডেকে এনেই খেলাধূলা করতাম।
আমরা ছিলাম পাঁচ ভাইবোন – দিদি বড়, তারপর আমি, আমার দুই ভাই ও তারপর সবার ছোট বোন। পিসিরা, মাসিরাও খুব কাছাকাছি থাকতেন, আসা যাওয়া লেগেই থাকতো। ভাইবোনদের সঙ্গে হুল্লোড় করে আমাদের ছোটোবেলাটা খুবই আনন্দে কেটেছে। এখন ওখানে আমার ভাইরা থাকে। মজার ব্যাপার হলো যে এতবছর দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে, সংসার করে অবশেষে এই কোলকাতাতেই ফিরে এসে আমি ওই বাড়ির খুব কাছেই আমার বাড়ি কিনেছি।
শুরুতে, মানে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে বাড়িতে বসে এবিসিডি শেখার সময়, তখন মা আমার টিচার। বাংলা, অঙ্ক, ইংরাজীর প্রাথমিক শিক্ষা আমার মায়ের কাছেই। যখন পাঁচ বছর বয়স হলো, তখন বাড়ির কাছেই কমলা গার্লস স্কুলে ক্লাস ওয়ানে গিয়ে ভর্তি হলাম। তখনও স্কুলে স্কুলে নার্সারি বা কেজি ক্লাসের অত চল ছিলনা। কমলা গার্লস তখনকার দিনে, মানে পঞ্চাশের দশকের শুরুর কথা বলছি, বেশ নামী স্কুল ছিলো। স্কুলে এত ভাল করে পড়ানো হতো যে বাড়িতে এসে ক্লাসের পড়া বা হোম টাস্ক নিজে নিজেই করা যেতো, পুরোটাই ছিলো সেলফ হেল্প। এইভাবেই একদম নিচু ক্লাস থেকেই আমাদের স্বাবলম্বী করে দেওয়ার চেস্টা করা হতো। আমার পিসিরা, কাকিমারাও ওই স্কুলেই পড়েছিলেন।
পড়াশোনার বাইরে, মানে ক্লাসের পড়া ছাড়াও আমি সেই ছোটবেলা থেকেই স্কুলের নানারকম এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটির সাথে জড়িত ছিলাম। স্কুলে নাচ শেখাতেন অনাদি শংকর আর মনি শংকর। পাশাপাশি রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রনাটকও শেখানো হতো। দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন, নীলিমা’দি স্কুলে এসে আমাদের গান শেখাতেন। নাটকের বেলায়, আমি অন্যদের থেকে কিছুটা লম্বা ছিলাম বলে আমাকে রবীন্দ্রনাথের বৌঠাকুরানির হাটে ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়েছিলো। আমার নিজের নাচ শেখার খুব ইচ্ছে ছিল, গুরুজনদের আপত্তি থাকায় গান শিখতে হলো। আমার এক দাদা একদিন আমাকে “শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সংঘে” নিয়ে যান, ওখানে আমি অনেক গুণীজনের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পাই। পরে অশোকতরু বন্দোপাধ্যায় ও প্রসাদ সেনের কাছেও গান শিখেছিলাম। স্কুলে প্রেয়ার লীডার হয়েছিলাম। তবে সবচেয়ে ভাল লাগত স্কুলের সেই পরিবেশ, আজ খুবই মিস করি।
একটু উঁচু ক্লাসে আমি হয়ে গেলাম ক্লাসের মনিটর, পরে স্কুলের প্রিফেক্ট। স্কুলে অনেক মনিটরই ছিলো, কিন্তু প্রিফেক্ট হতো মাত্র্র একজনই, খুবই সম্মানের পদ ছিলো। অনেক মেয়েদের মধ্যে স্কুলের কর্তৃপক্ষ মনিটর, বা প্রিফেক্ট বেছে নিতেন। আমাকে প্রিফেক্ট লেখা একটা ব্যাজ দেওয়া হয়েছিল, আমার মা সেটা অনেক দিন রেখে দিয়ে ছিলেন। আর স্কুল এক্টিভিটি বলতে ১৫ই আগস্ট যে কয়জন প্যারেডের জন্য সিলেক্ট হতো, আমিও সেই প্যারেডে থাকতাম। আগেই বলেছি, লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্কুলে অন্যান্য কার্যকলাপেও খুব উৎসাহ দেওয়া হত, সেরকমই ছিল প্যারেড কম্পিটিশন। প্রতি বছর ১৫ই আগষ্ট সারা কোলকাতা থেকে প্রায় ৩৫-৪০ স্কুল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এই প্রতিযোগিতায় ভাগ নিতো। ব্রিগেড গ্রাউন্ডে অন্তত সাত আটবার আমাদের স্কুলের প্যারেডে আমিও গিয়েছি। সেরার প্রাইজও অর্জন করেছি। আর লম্বা বলে সবার শুরুতে ব্যানার থাকতো আমারই হাতে।
ক্লাস ইলেভেনে উঠে স্কুলের প্রিফেক্ট হওয়ার দরুন আমার কাঁধে কিছূটা অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হলো। প্রিফেক্ট সম্বন্ধে বলে রাখি, স্কুলের টিচাররা সব ছাত্রীদের মধ্যে একজনকে নির্বাচন করতেন। মানে স্টুডেন্ট এম্বাসাডর। সহজভাবে বললে represents students community, and also responsible their behavior.
স্কুল থেকে প্রায়ই ইনভিটেশনে যেতাম, যেমন ইন্টার স্কুল কম্পিটিশন, একজিবিশন। আর প্রতি বছর স্কুল থেকে আমাদের অনেক জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। চিড়িয়াখানায় বাঁদরের খাঁচায় আমাদের অতিরিক্ত উৎসাহ ছিলো। স্কুল থেকে নিয়মিত ভালো ভালো সিনেমায় নিয়ে গেছে। এত বছর পরে সব সিনেমার নাম মনে না থাকলেও কয়েকটা নাম মনে আছে, যেমন বেন হার, পথের পাঁচালী, টেন কমান্ডমেন্টস। স্কুল স্পোর্টসেও আমি বেশ ভালো ছিলাম। ভালো ব্যাডমিন্টন খেলতাম। আর চু কিত কিত খেলতে গিয়ে হাত ভেঙ্গে বসে রইলাম।
এইভাবেই পড়াশোনা আর নানারকম গান, নাটক, আর হৈচৈ করেই এগারোটা বছর কেটে গেলো।
এরপর, মানে স্কুল পেরিয়ে যখন কলেজে ভর্তির সময় একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটে গেলো। একটু আগেই বলেছি, স্কুল থেকে আমাদের অনেকরকম এক্সকার্শনে নিয়ে যেতো। যখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি, সেবার স্কুলের বাসে করে বিই কলেজের রিইউনিয়নের একজিবিশনে গেলাম। কলেজটাকে প্রথম দেখেই খুব ভালো লেগে গেলো। বিরাট মাঠে তাঁবু খাটিয়েছে, আর মাঠের তিনদিকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল একজিবিশন চলছে সায়েন্স, আর টেকনোলজির। অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি আর সরকারি ডিপার্টমেন্টের প্যাভিলিওন আছে। বিই কলেজের ছাত্রদেরও নিজেদের ইঞ্জিনিয়ারিং প্যাভিলিওনও আছে। আমাদের দেখে কলেজের অনেক ছেলেরাই উৎসাহী হয়ে নিজেদের প্যাভিলয়নে আমন্ত্রন জানালো। এক জায়গায় দেখলাম, বিই কলেজের ছাত্ররা ভিডিও কনসেপ্ট নিয়ে মডেল বানিয়েছে। সেই প্রথম ভিডিও কনসেপ্ট নিয়ে ওয়ার্কিং মডেল দেখলাম, জিনিষটা বুঝতে চেষ্টা করলাম। তোমরা ভাবো একবার, সেই ষাট বাষট্টি বছর আগে ৫৯-৬০ সাল নাগাদ বিই কলেজের একজিবিশনে ভিডিও কনসেপ্ট। আমি সত্যি কথা বলছি, এতটাই ইম্প্রেসড হয়েছিলাম যে বাড়িতে এসে বললাম, আমি বিই কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বো। শুধু আমি নই, আমাদের স্কুলের আরও দু’টি মেয়ে বাড়িতে একই কথা বললো। আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বো। আমার কথা শুনে বাড়িতে রীতিমত অভিভাবকদের সভা বসে গেলো। মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায়? বাড়িতে খবর আছে, বিই কলেজে পড়তে হলে হস্টেলে থাকতে হবে। তাহলে কি উপায়? তবে, ঠাকুর’মা আমাকে সাপোর্ট করলেন, শুরুতেই বলেছি তিনি ছিলেন যুগের অনুযায়ী অনেকটাই প্রগ্রেসিভ। এরপর আমার কলেজের ভর্তির ফর্মে বাবা সই করে দিলেন।
যথাসময়ে ক্লাস ইলেভেনের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার পর বাবার কাছে আবদার করে বি ই কলেজের ভর্তির পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষায় পাশ করে গেলাম, ইন্টারভিউএর ডাক এলো। মনে আছে, বোর্ডে ছিলেন ডক্টর বড়াল, শুধু একটাই প্রশ্ন করেছিলেন, কেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাই। বললাম, মনের কথা। ব্যাস আমার নাম লিস্টে উঠে গেলো। কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম।
কিন্তু যে আমি, স্কুলে এত একটিভ ছিলাম, বিই কলেজে গিয়ে সেই সুযোগটাই পেলাম না। দু’হাজার ছাত্রের ক্যাম্পাসে মাত্র গোটা দশেক মেয়ে। সুতরাং ক্যাম্পাসে পড়াশোনার বাইরে যা কিছু সুযোগ সুবিধা, সবই ছেলেদের জন্য। যে আমি এতটাই খেলাধূলা ভালোবাসতাম, সেই আমি কলেজের এন্যুয়াল স্পোর্টসের দিনে ব্যালেন্স রেসে মুখে চামচের ডগায় লজেন্স, বা মাথায় হাঁড়ি নিয়ে দৌড়াতাম, বা মিউজিক্যাল চেয়ার। এই ছিলো তখনের বিই কলেজের মেয়েদের খেলাধূলা। আর কলেজের কিছু ইভেন্টে যেমন রিইউনিয়ন, তখন সেজেগুজে আমাদের কাউন্টারে গিয়ে বসতে হতো। কলেজের রিইউনিয়নের সময় চারদিন ধরে ফাংশন হতো, শেষ দিনে থাকতো ক্লাসিকাল প্রোগ্রাম। এমনিতে নটার মধ্যে আমাদের হষ্টেলে ফিরতে হতো, তবে ওই ক’দিনের জন্য ছাড় পেতাম। ব্যাস, এই ছিলো আমাদের ছোট্ট জগৎ। এক রিইউনিয়নে ভোরের দিকে বিলায়েত খান এসেছিলেন, চার ঘন্টা ধরে বাজিয়েছিলেন, সবশেষে ধুন। সেই দিনটা খুব মনে আছে। আমি তো সেদিন ঠিকই করে ফেলেছিলাম, আমাকে সেতার শিখতেই হবে। বন্ধুরাই আটকালো।
আমাদের হস্টেলে, মানে একটা স্টাফ কোয়ার্টার ব্লকের তিনতলা আর চারতলার সবকটা ঘর মিলিয়ে জনা দশেক মেয়ে ছিলাম। শুরুতে র্যাগিং মানে আমাকে জানালা দিয়ে ভুতের ভয় দেখিয়েছিলো, সেটা মনে আছে। প্রথম দিনের ক্লাসে যাওয়ার কথা মনে আছে। শাড়ি পড়ে আয়নার সামনে হাতে চিরুনি নিয়ে বসে আছি। এতদিন বাড়িতে মা’ই স্কুলে যাওয়ার আগে আমার চুল আঁচড়ে বিনুনি বেঁধে দিতেন। সেই বিনুনি বাঁধা তো আমার শেখা হয় নি! আমার সিনিয়র দিদি খেয়াল করলেন, আমি বোধহয় কিছু সমস্যায় পড়েছি। সব বললাম। শুনে ওঁদের কি হাসি। যাই হোক, সেদিন নতুন পাতানো দিদিই আমার চুল বেঁধে দিলো। ঘটনা হয়তো সামান্য, কিন্তু সেই যে বাড়ি থেকে অনেক দূরে, একে অন্যের খেয়াল রাখা, সেটা উপলব্ধি করেছিলাম। বিই কলেজের সেই কয়েকটি বছরে যে কয়জন বোর্ডারের সাথে দিনরাত একসাথে সুখে দুঃখে কাটিয়েছিলাম, পরবর্তী জীবনে এখনও তাঁদের সাথে হৃদয়ের গভীর যোগাযোগ রয়ে গেছে।
বছর খানেক পরে সিনিয়র হয়েছি। ছবি’দি এসে বললো, এবারের নতুন মেয়েদের বেসুরো গান শেখাতে হবে। এটাই নাকি র্যাগিং। এই দ্যাখো!! যে আমি গান শিখেছি, সেই আমাকেই বেসুরো গান গাইতে হবে? আর সেটা আবার অন্য একজনকে শেখাতেও হবে? কিছু করার নেই। দিদির আদেশ মেনে অতি কষ্টে বেসুরো গান শেখালাম। গোলমাল বাধলো ঠিক তার পরেই। বাথরুমে স্নান করার সময়, আমার গান শুনে মেয়েটি বললো, দিদি, তুমি তো ভালোই গান গাইতে পারো, তবে তখন কেন এরকম বেসুরো গান গাইলে?
আমাদের প্যারোডি গান ছিলো, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের “বেকারার করকে হামে ইউ না যাইয়ে”র সুরে
বেকারার কেন পড়া ইঞ্জিনিয়ারিং
সেই তো বাবা ঠেলবে হাঁড়ি দিনের পরে দিন
সবসময় গেড়েমি তো ভালো নয়,
তাই বলেও কি বটসে যাওয়া চলবে না,
সামনে চেয়ে আস্তে পায়ে চলবে টিপটিপ,
সবসময়ে মনে রেখো সুপার আছে ঠিক।
এরপর এক দোলের দিনের রাতে প্রফেসর একেসির (প্রফেসর অনিল চৌধুরী, আনারকলি নামে খ্যাত) বাড়িতে নিমন্ত্রণ, আমাকে গান গাইতে হবে। কিছু গান গাইবার পরে গাইলাম সেই বেকারার কেন পড়া ……
হস্টেলে টেবিল বাজিয়ে আমাদের গান হতো। আর নিচের তলার প্রফেসর রত্নেশর বোস বিরক্ত হতেন।
(অনেক পুরনো এলবাম থেকে)
এবার আমাদের সিনেমা দেখার গল্পও বলতে হয়। ক্লাশ হতো সকালে ৭টা থেকে ১১টা, দু ঘন্টার লাঞ্চ ব্রেক তার পর আবার ১টা থেকে ৪টে, এদিকে সিনেমায় যেতে হলে শো এর সময় ৩টে, ৬টা, ৯টা। সবথেকে কাছের হল ছিলো মায়াপুরী। ৩টের শোয়ে যাওয়া যাবে না আবার ৯টার মধ্যে হষ্টেলেও ফিরতে হবে – তাহলে ৬টার শোয়ের পুরোটা দেখা যাবে না। আমরা সিনেমা হলের লোকজনদের ধরে ৫টার সময় গিয়ে আগে সিনেমার সেকেণ্ড হাফটা দেখে নিয়ে তারপর ৬টার শোতে প্রথম ভাগটা দেখে নিতাম। তারপর রাত ৮ টার মধ্যেই হষ্টেলে ফিরে আসতাম। ঐ সিনেমা হলের কর্তৃপক্ষরা আমাদের এই আবদারটুকু মেনে নিয়ে সত্যি কথা, খুবই সহযোগিতা করতেন।
এবার হস্টেলের খাওয়া নিয়ে। যেহেতু আমাদের কিচেন ছিলো না, তাই অন্য হস্টেল থেকে দু’বেলাই খাবার আসতো। মাছ মাংস তাও পদের ছিলো, কিন্তু মোটা মোটা রুটি খেতে বেশ অসুবিধে হতো। সকাল ১১টার ক্লাসের ক্লাশে প্রায়ই ছেলেদের বলতে শুনতাম “তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন স্যার, মাছ ফুরিয়ে যাবে”। আমাদের ওই সব মুস্কিল ছিলো না। আর মাসে দু’দিন – স্পেশাল ডায়েট আর ফিস্টের দিন বিশেষ খাবার আসতো। অনেক সময়ে বছরের শেষে মেস ফিতে সারপ্লাস বলে ছ টাকা চার আনা ফেরৎ পেয়ে আমাদের কী আনন্দ– সকলে মিলে জ্যাঠামশাই এর দোকানে গিয়ে পার্টি হতো।
একবার আমাদের নিশুতি রাতের এডভেঞ্চারের শখ হলো। কয়েকজন মিলে রাতের অন্ধকারে প্রফেসর এসি রয়ের বাড়ির বাগানে হানা দিলাম। ওদিকে পাহারা চলছে। আমরা কয়েকজন মিলে বড় একটা কলার কাঁদি চুরি করে সমস্যায় পড়লাম এটা নিয়ে এখন কি করি? হস্টেলে নিয়ে গেলে লোক জানাজানি হয়ে কেলেঙ্কারি, এমনকি শাস্তিও হতে পারে। ঐটুকু সময়ের মধ্যেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে গোটা কলার কাঁদিটাকে ওভালের পাশের ঝিলের জলে ফেলে দিলাম। এখন হাসি পায়, কেন যে সেদিন রাতের অন্ধকারে দলবেঁধে চুরি করতে গেলাম, আর কেনই বা চোরাই মাল ঝিলের জলে ফেলে দিলাম। আসলে ঐ বয়সে নিছক আনন্দের বশে আমরা কত কিই না করে ফেলি!! আরেকবার পান্ডিয়া হস্টেলের বাইরের বাগানে দেখি টোপা কুল গাছ। কটা’ই বা কুল, সামান্য কিছু। কিন্তু চোরাই মালের উত্তেজনা আর আনন্দই অন্যরকম। সেই সামান্য কয়েকটা কুল পেড়ে ক্লাসে গিয়ে সকলের মাঝে বিতরন করছি, স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। স্যার মানে, ডঃ শংকর সেন। আর পালাই কোথায়? আমাদের স্বাধীনতা ছিলো সীমিত, আমাদের স্যারেরা সত্যি লোকাল গার্জিয়ানদের মত করে আমাদের খেয়াল রাখতেন।
ক্যাম্পাসে আমাদের কিছু অসুবিধেও ছিলো। ক্লাসের ব্রেকে কোথায় গিয়ে বসবো? ক্যান্টিন তো পুরোটাই ছেলেদের দখলে। আরেকটা কথা, হাতে কটাই বা পয়সা পেতাম যে, চা শিঙাড়া কিনে খাবো? ইলেকট্রিক্যাল আর মেকানিক্যাল ডিপার্ট্মেন্টের মাঝখানে সিমেন্ট বাঁধানো গাছতলায় আমরা ক্লাসের ব্রেকে বসেছিলাম। সেটাতেও আপত্তি।
এবার আমাদের মাষ্টারমশাইদের নিয়ে কিছু কথা বলি। শুরুতেই বলি, অনেক অনেক ভাগ্য করে এত ভালো একাধারে পন্ডিত অন্যদিকে স্নেহশীল স্যারেদের সান্নিধ্যে আমরা আসতে পেরেছিলাম। প্রফেসর বড়াল, প্রফেসর একেসি (আনারকলি), আর প্রফেসর শঙ্কর সেনের বাড়িতে আমার অবাধ যাতায়াত ছিলো। প্রফেসর একেসির মেয়ে পুপু (তিলূ নামেই পরে সবাই ওঁকে চিনেছে), আর ডক্টর বড়াল, মিসেস বড়াল ও ওনার মেয়েদের সাথে আজও আমার খুব ভালো যোগাযোগ রয়ে গেছে, মানে বিগত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি। আমাদের ম্যাথসের হেড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্ট, প্রফেসর এস সি চক্রবর্তীকে খুব ভয় পেতাম। উনি ছিলেন খুব রাগী, আর খুব কমই ওনাকে হাঁসতে দেখেছি। আর ছিলেন প্রিন্সিপ্যাল এসি রয়। ওভারকোট গায়ে গ্যাঁটগ্যাঁট করে হস্টেলে চলে আসতেন। ভাইস প্রিন্সিপাল প্রফেসর বরদা চ্যাটার্জির কথাও মনে পড়ে, উনি আমাদের সুপারও ছিলেন। সকলের নাম উল্লেখ করতে পারলাম না, কিন্তু আমার বিনীত শ্রদ্ধাটূকু প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
কলেজ থেকে পাশ করে এইচ এম ভি-তে চাকরী পেয়ে গেলাম। কোম্পানিতে হৈ হৈ ব্যাপার, এই প্রথম একজন মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার আসছেন। অথচ মেয়েরা চাকরি করবে, কোম্পানিতে সেইরকম ব্যাবস্থাই (আজকের দিনে বলে ইনফ্রাস্ট্রাকচার) তো নেই। খুব তাড়াতাড়ি মেয়েদের জন্য একটা ঘর আর নতুন একটা মেয়েদের টয়লেট (ওয়াশ রুম, আজকের দিনে বলে) তৈরি হয়ে গেলো। এতকিছুর পরেও আমার ওখানে চাকরী করা হলো না। আমার প্রাগ্রেসিভ ঠাকুর’মা বলে দিলেন, তোমার আবদারে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছ, কিন্তু আমাদের বাড়ির মেয়ে বউরা চাকরি করে না, এবার যা করবে বিয়ের পরে। আর হবি তো হ, আমার হবু হাজব্যান্ড শ্রীযুক্ত রণেনবাবু ঠিক তখনই আমেরিকা থেকে ফিরে কানপুর আইআইটি-তে জয়েন করলেন। আমার পিসি ডক্টর নবনীতা দেব সেন এই সম্বন্ধটা এনেছিলেন, বার্কলেতে থাকার সময় থেকেই ওদের চেনাশোনা। সম্বন্ধ করে দু’বাড়িতে বিয়ের পাকা কথাও হয়ে গেলো। একদম শুরুতে আমি একটু খুঁতখুঁত করছিলাম, পাত্র বিই কলেজের ইঞ্জিনিয়ার নয়। সে যাই হোক, বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে দেখি ডক্টর বড়াল, ডক্টর জয়ন্ত সেন, ডক্টর প্রভাত সিনহারয় সকলেই রণেনকে খুব ভাল করে চেনেন। ডক্টর বড়ালের কানে কথাটা গেলো যে আমি খুঁতখুঁত করছি, পাত্র বিই কলেজের ইঞ্জিনিয়ার নয়। উনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। ডেকে ধমক দিলেন, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছ বলে কি নিজেকে বিরাট কিছু মনে করো? বি ই কলেজের বাইরে কি কিছুই বোঝোনি? রণেন প্রেসিডেন্সির ছাত্র, সায়েন্স কলেজের স্কলার, বার্কলের ডক্টরেট। যথেস্ট উপযুক্ত আর ভালো ছেলে। চুপচাপ বিয়েটা করে ফেলো। …… বিয়েটা হয়ে গেলো। আর অচেনা লোকটাকেও অল্প সময়ের মধ্যেই খুব ভালো লেগে গেলো।
এবার কানপুর আইআইটি। শীতকাল। উত্তর ভারতের ঠাণ্ডার সঙ্গে আগে পরিচয় ছিলো না। চারিদিকে লনে ঘেরা বড় বাংলো, যতক্ষণ সূর্য থাকতো লনে বসে থাকতাম তারপর ভেতরে এসে হীটার জ্বেলে নিতাম। ক্যাম্পাসটা বিরাট, মানে পায়ে হেঁটে হস্টেল বা কোয়ার্টার থেকে ইন্সটিটিউট যাওয়া আসা করা যায় না। ক্যাম্পাসের অন্যরা অনেকেই একলা বা পিছনে ফ্যামিলি নিয়ে সাইকেলে যাতায়াত করতো। আমাদের গাড়ী ছিলনা, রণেনের সাইকেল ছিলো। রণেন আমাকে সাইকেলের পিছনে বসতে বলায় আমি তাতে ঘোর আপত্তি জানাই। দেখলাম আমাকেও সাইকেল শিখতে হবে। কত আর রণেন আমাকে পিছনে বসিয়ে সাইকেল টানবে? তাই শিখতেই হলো, রণেনই শিখিয়ে দিলো। রণেন আমাকে সাইক্লিং শিখতে বললো, শাড়ী পরেই সাইকেল চালানো শিখলাম। কিছুদিন পরে ওখানে খুব বড় সুইমিং পুল হলে বাড়ির সকলের উৎসাহে সুইমিং শিখলাম। আইআইটি তে যতদিন ছিলাম, সাইক্লিং ও সুইমিং দুটোই খুব উপভোগ করেছি, এখনো কল্পনা করি।
আমাদের আইআইটি ক্যাম্পাস শহর থেকে ছিলো বারো কিলোমিটার দূরে, যাতায়াতের রাস্তার দুপাশে খোলা ধূধূ মাঠ। চোখের নজরে গাড়ি ঘোড়া কিছুই নেই। অতি বাজে একটা পাবলিক ট্রাসপোর্ট আছে, দিনে মাত্র একবার রেল স্টেশন থেকে আমাদের দিকে আসে। মানে কিছু বাজারহাট করতে হবে। দু ঘন্টা অপেক্ষা করেও বাস এলো না, অথচ জরুরী জিনিষপত্র কিনতেই হবে। পরের দিন জানলাম যে বাস খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। এরপর তিন চাকার টেম্পো সার্ভিস চালু হলো। সমস্যার কিছুটা সমাধান হলো।
বিয়ের পর প্রথমে আমি চাকরি করতাম না আর বাড়িতে দু’জন কাজের লোক থাকাতে কোন কাজও আমাকে করতে হতো না, একটু একঘেয়ে লাগতো। একদিন রণেন বললো, শহরে একটা বড় মিউজিক কলেজ আছে চলো গিয়ে দেখি। সে এক বিরাট কলেজ, প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে বললাম, গান শিখতে চাই। উনি বললেন, একটা গান গাইতে হবে, আওয়াজ শুনবো। বাংলা গান করলাম, বললেন ভর্তি হয়ে যান।
এতদিন রবীন্দ্রসংগীত এইসব শিখেছি, গেয়েছি। এবার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, প্রথমে একটু ভয় ভয় করতো। তারপর ভালো লাগলো। এই সময় আই আই টি তে বেশ কিছু প্রজেক্ট আসতে শুরু করেছে। আমি প্রজেক্ট ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজে জয়েন করলাম। বেশ কয়েক বছর কাজ করার পর আই আই টি তে ইউ এন ডি পি থেকে খুব বড় একটা Computer Aided Design (CAD) প্রজেক্ট এলো সেখানে রিসার্চ ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে দশ বছর কাজ করার পর, ইন্সটিটিউট ইঞ্জিনীয়ার হলাম। ইন্ডাস্ট্রির লোকেদের জন্যে আই আই টি থেকে প্রায়ই শর্ট টার্ম কোর্স অফার করা হতো – তাতে পড়াতাম, ল্যাব নিতাম। তারই পাশাপাশি গুরুজিদের স্নেহ ও যত্নে “অখিল ভারতীয় গন্ধর্ব মহামণ্ডল” থেকে সঙ্গীত বিশারদ (বি মিউজ ) ও সঙ্গীত অলংকার (এম মিউজ) করলাম। গুরুজিরা আমাকে ওই কলেজেই শিক্ষকতা করতে বললেন, কিন্তু একসঙ্গে দুটো চাকরি করা সম্ভব নয় তাই ওঁদের প্রস্তাবে রাজি হওয়া গেলো না। সেই সময় আই আই টি ক্যাম্পাসে বাচ্চাদের গান বাজনা নাচ শেখার সুবিধের জন্য একটা মিউজিক স্কুল খোলা হলো, প্রায় ১০০-১৫০ বাচ্চারা শিখতো। প্রথমে ওখানে আমি গান শেখাতাম. দুবছর পরে প্রিন্সিপাল হলাম। গান শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা দেওয়ানো, নানা রকমের প্রোগ্রাম করানোর দায়িত্বও বেড়ে গেলো।
আই আই টি তে আমাদের একটা নাটকের দলও ছিল, বছরে একটা তো নিশ্চয় কখনো দুটো-তিনটে নাটকও করেছি। আই আই টি কসমোপলিটান জায়গা। ওখানে নানা রাজ্যের নানা ধর্মের লোক এক সাথে থাকতাম তাই কালী পূজো, সরস্বতী পূজো, হোলি, দিওয়ালি, গণেশ চতুর্থী, গুরু নানকের জন্মদিন, পোঙ্গল, ইদ, ক্রিসমাস সমান উৎসাহে পালন হতো। কালী পূজোয় তুবড়ি বানাতাম। হোলির দিন সকাল থেকে রং খেলে সন্ধেবেলা খোলা আকাশের নীচে পূ্র্ণিমার আলোয় নাচ গান খাওয়া দাওয়া চলতো। নানকের জন্মদিনে গান গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করসেবাও করেছি। তাছাড়া সাই ভজন, গীতা চর্চা গ্রুপেও ছিলাম। এরকম করেই চাকরি, গান, নাটক ও নানা রকম মজা করে কখন যে আই আই টি তে চব্বিশটা বছর কেটে গেল বুঝতেই পারিনি।
এই সময় একটা ঘটনা আমাদের জীবন বদলে দিলো। আমাদের পরিবার খুব ছোট, রণেনের নিজের কোন ভাইবোন নেই। পরিবার বলতে শাশুড়িমা, রণেন, আমাদের ছেলে ও আমি। আমার শাশুড়িমা অল্প কয়েক দিন অসুস্থতার পর চলে গেলেন। আমাদের ছেলেও হষ্টেলে, বাড়িটা খুব ফাঁকা লাগতো, জায়গা বদলের দরকার ছিলো। এই সময় রণেনের কাছে CSIR এর “Central Electronics Engineering Research Institute (CEERI), পিলানীতে ডাইরেক্টর হিসাবে জয়েন করার অফার এল, আগেও এসেছিল, তখন নেননি এবার নিলেন। ২৫ বছর পর আই আই টি ক্যাম্পাস ছাড়লাম, কিন্তু আই আই টি কানপুরের সঙ্গে এখনো গভীর যোগাযোগ আছে, কোন না কোন কারণে ঘন ঘন ওখানে যাওয়া হয়েই থাকে।
রণেন পিলানী গেল, আমিও BITS Pilani তে ইলেকট্রনিক্স ডিপার্টমেন্ট এ লেকচারার হিসাবে জয়েন করলাম। কিছুদিন পড়ানোর পর মনে হলো আরও পড়াশুনা করার দরকার —মাষ্টার্স প্রোগ্রামে জয়েন করলাম। পড়ানো ও পড়া একসঙ্গে চললো – Software Systems এ মাষ্টার্স করলাম। এখানেও একটা মিউজিক স্কুল করেছিলাম, দুটো স্কুলই এখনো চলছে। ইতিমধ্যে রণেনের আগ্রহে জয়পুর রেডিওতে অডিশন দিয়ে নিয়মিত গাইতে লাগলাম। পড়ানো, গান শেখানো, গান গাওয়া নিয়েই সময়টা কেটে গেলো।
রণেন CEERI থেকে আই আই টি তে ফিরে গিয়ে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলো, এরপর IIT Madras এর সহযোগিতায় একটা বেসরকারি Telecom Training Academy তৈরি করার দায়িত্ব নিয়ে চেন্নাই চলে গেলো। আমিও চেন্নাইতেই একটা ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে অ্যাসিসটেন্ট প্রোফেসরের চাকরি নিলাম, কর্তৃপক্ষ আমাকে CSE, IT, MCA – তিন ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব দিলেন। 700 ছাত্রছাত্রী ও 40জন ফ্যাকালটি মেম্বারের ভালো মন্দের ভার, প্রথমে একটু ভয় করলেও পরে ঠিক হয়ে গেলো। তিন বছর দক্ষিণ ভারতে কাটানোর পর হঠাৎই আমাদের কাছে ডাক এলো গুজরাটে Reliance এর উদ্যোগে সদ্য গড়ে ওঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় DAIICT থেকে। সেখানে আমি সুযোগ পেলাম কম্পিউটার সায়েন্স কোর্সের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখানোর। এখানে পাঁচ বছর কাজ করার পর, পারিবারিক কারণে কলকাতায় এলাম। এরপর তিনবছর কলকাতা ও দিল্লীর নানা বেসরকারি সংস্থায় কম্পিউটার সায়েন্স পড়ালাম।
ভারতের উত্তর, দক্ষিণ,পূর্ব পশ্চিমে বিভিন্ন রাজ্যের ছটা বিশ্ববিদ্যালয় তে কাজ করে কত রকমের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হল, কত কিছু শিখলাম কত কিছু শেখালাম, সবচেয়ে ভাল লাগত ছাত্র ছাত্রী দের। সব শেষে 2014 তে আমরা যোগ দিলাম “শিব নাডার বিশ্ববিদ্যালয়ে”। ওখানেও আমি কম্পিউটার সায়েন্স ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত দুটোই শেখাতাম। বেশ ভালই চলছিল,হঠাৎ 2020 তে করোনা র কামড়—অন লাইন টীচিং শুরু, তিন সেমিষ্টার পড়ালাম – ভাল লাগছিল না – 2021 এর মে মাসের শেষে ছেড়ে দিলাম। বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। উত্তর প্রদেশে চাকরি জীবন শুরু করেছিলাম, নানান জায়গা ঘুরে আবার সেখানেই চাকরি জীবন শেষ করলাম।জীবনের সায়াহ্নে এসে মনে হয় জীবনে যা দিয়েছি তার থেকে অনেক বেশী ফেরৎ পেয়েছি। গুরু পূর্ণিমার দিন অথবা টীচার্স ডে তে যখন ছাত্র ছাত্রীদের কাছ থেকে ফোন বা ইমেল আসে ওরা বলে তোমার লেকচারের ওই অংশ অথবা প্রজেক্টে ওই সাজেশন কী ভাবে কাজে লেগেছে অথবা তোমার শেখানো গানগুলো গাই, তখন আমার চারিপাশের জগৎটা রূপে রসে গন্ধে বর্ণে ভরে যায়।
এখন কোলকাতায় আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আনন্দে অবসর জীবন কাটাচ্ছি।
সকলের ভাল হোক।
wow1
Bany, wonderful. learnt so much about you/
Love always,
Swapna from NY